গতকালও খেতের সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করেছি। আজ সকালে খেত থেকে সবজি তুলতে গিয়ে দেখি—আমার খেত আর নাই, পুকুর হয়ে গেছে। এই জমির আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলত
গতকালও খেতের সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করেছি। আজ সকালে খেত থেকে সবজি তুলতে গিয়ে দেখি আমার খেত আর নাই, পুকুর হয়ে গেছে। এই জমির আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলত। এখন আমার মাথায় বাড়ি। আমাদের কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে মাটি লুট করে নিয়ে গেল। এই বিচার কার কাছে দেব?’ এক রাতের ব্যবধানে ফসলি জমি ২০ ফুট গর্তের জলাভূমি করা জমির আইলে বুক চাপড়ে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক সাইমুন। পাশে বিলাপ করছিলেন তার বোন রাহেলা বেগম, মনোয়ারা বেগম। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত কমপক্ষে ২০ জন কৃষকের অভিযোগ টাকার প্রলোভন ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ভীতির কারণে খুইয়েছেন তাদের তিন ফসলি আবাদি জমি। এভাবেই কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ফজলিয়া হেফজখানার উত্তর পাশে দরগাহ মাজার সংলগ্ন বিলের তিন ফসলি কৃষিজমি থেকে রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে মাটি। এসব মাটির শেষ ঠিকানা হচ্ছে রামু ও সদরের অবস্থিত বিভিন্ন ইটভাটায়। শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সকালে সরেজমিনে ঝিলংজার দরগাহ পাড়া মাজার সংলগ্ন বিলে গিয়ে দেখা গেছে, কৃষকের অনুমতি ছাড়াই কয়েক বিঘা ফসলি জমির মাটি রাতের আঁধারে কেটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। খননকৃত খেতের পাশেই চিৎকার করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইছেন কৃষক ও কৃষানিরা। জমির পাশেই রয়েছে এক্সকাভেটর বা মাটি কাটার বিশাল খনন যন্ত্র। পাশেই এমআরসি ব্রিকস ইটভাটায় মাটির পাহাড় জমে আছে। রাতে মাটি কাটার জন্য পুরো চক জুড়ে আলোর ব্যবস্থা করে রেখেছে। ডিকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান, নাজির হোসেন, ঈমান আলী ও আরমান বলেন, এই চকে কয়েক শত বিঘা জমিতে ধান, আলু, করলা, মিষ্টি লাউ ও বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। ওই এলাকার মাটি ব্যবসায়ী ধলু, ঝিলংজা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি রুহুল আমিন, ৭ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি আনছার, ঝিলংজা ইউনিয়ন যুবদলের আহবায়ক রশিদ আহমদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক বেদারসহ আরও স্থানীয় বিএনপির আরও কয়েক জন প্রভাবশালী কৃষিজমি থেকে এক্সকাভেটর দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে বিক্রি করছেন। এতে পাশের কৃষি জমির মাটি ভেঙে পড়ছে। মাটিকাটা বন্ধ না করলে এই বিল থেকে কৃষিজমি হারিয়ে যাবে। অভিযোগ উঠেছে, পরিবেশ আইন অমান্য করে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন যাবত এই চকের ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। প্রথমে এলাকার চিহ্নিত দালালরা লোভনীয় অফার দিচ্ছে কৃষকদের। রাজি না হলে দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি। তাতেও যদি কৃষি জমির মাটি বিক্রিতে অনীহা দেখায় কৃষক, তাহলে রাতের আঁধারে তাদের অনুমতি ছাড়াই কেটে নিচ্ছে এসব জমির মাটি। আরও দেখা যায়, ঝিলংজার ৯নং ওয়ার্ডের খামারপাড়া-বড়ুয়াপাড়া এলাকায় ফসলি জমি থেকে প্রতিদিনই মাটিকাটা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এক্সকাভেটর দিয়ে ১০ থেকে ২০ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এসব গর্তে পাশের কৃষিজমির মাটিও ভেঙে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সাইমুন বলেন, বোন মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় ৩৩ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে করলা চাষাবাদ করছিলাম। সকালে খেতে সবজি তুলতে গিয়ে দেখি খেতে মাটি নাই। খেতের ফসল নষ্ট করে রাতের আঁধারে মাটি কেটে নিয়েছে বিএনপি নেতা রুহুল আমিন, বেদার ও যুবদল নেতা রশিদ। জমির মালিকদের সঙ্গে কথা না বলেই তারা মাটি কেটে নিয়েছে। মাটি খেকুরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে; জোরপূর্বক রাতের আঁধারে সবজি ক্ষেত ও আমন ধানের জমির মাটি কেটে পুকুর খনন করতেও দ্বিধা করছেনা। আর এসব মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। আবার অনেকে বাড়ির ভিটা তৈরির জন্য মাটি কিনে নিচ্ছেন। এতে দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে বিলীন হতে শুরু করেছে কৃষিজমি। প্রশাসনের নীরবতার কারণে ভূমি আইন অমান্য করে অবাধে অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি বিক্রি করেই চলছে অসাধু মাটিখেকোরা। যেন দেখার কেউ নেই! অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তাবাবুরা মাসোয়ারা নিয়ে এসুযোগ করে দিচ্ছে মাটি খেকুদের। গত কয়েক বছরে শত শত পাহাড় নিধন কিংবা কৃষি জমির মাটি কেটে জলাশয়ে পরিনত করা হলেও খুব বেশি আলোচনা না হলে জনবল সংকটের অজুহাতে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থের বিনিময়ে 'ম্যানেজ' করে ফসলি জমি ধ্বংস করে মাটি বিক্রির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন মাটিখেকোরা। মাটিখেকোদের উৎপীড়নে দিশাহারা হয়ে উঠেছে ফসলি জমির মালিক ও কৃষি শ্রমিকরা। তবে মাটিখেকোদের পরামর্শে কোনো কোনো জমির মালিক জমিতে ফসল ফলানোর পরিবর্তে নির্বোধ কৃষকরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর এই মাটি বহনকারি ডাম্পার চালাচলের কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী করা গ্রামীণ সড়কগুলোর বারোটা বাজাচ্ছে। কৃষকদের কান্নার শব্দে বাড়িতে থাকা যাচ্ছেনা উল্লেখ করে তারা আরোও বলেন, বিলের কৃষি ও খালের বাধ কেটে পুকুরে পরিনত করা হচ্ছে। কিছুদিন ধরে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলে আসলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেন নি। রাতে কয়েকজন কৃষকের আহাজারি শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে শত শত ডাম্পার দিয়ে মাটি কাটার মহোৎসব দেখতে পাই। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকবছরে মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। মাটি খেকুদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি। মাটি ব্যবসায়ীদের লুট থেকে বাদ যাচ্ছে না খাসজমি, খাল ও নদ-নদীর তীর। এসব মাটির শেষ ঠিকানা হচ্ছে ইটভাটা। গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়ায় এরই মধ্যে শতাধিক একর কৃষিজমি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। জমিগুলোয় বোরো ধান আর শর্ষে চাষ করা হতো। গভীর গর্ত করে মাটি কাটায় ওই সব জমিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। দরগাহ পাড়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ওই এলাকায় অন্তত ৪০ বিঘা জমির ওপর বিভিন্ন সবজি লাগিয়েছেন স্থানীয় কৃষকেরা। রাতের আঁধারে বিএনপি নেতা ও তাদের সঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে কৃষিজমি থেকে স্কেভেটর দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে পাশের কৃষিজমির মাটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মাটিকাটা বন্ধ না করলে একসময় ওই এলাকা থেকে কৃষিজমি হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা। একই এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতিদিন রাতে কোনো না কোনো কৃষিজমির মাটি লুট করে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা বিএনপি নেতারা। কৃষিজমির মাটি লুটের বিষয় নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি আমরা। স্থানীয় প্রশাসনও তাদের কিছু বলে না। কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা বেআইনি। কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মাটি ব্যবসায়ী বিএনপি নেতা রুহুল আমিন বলেন, আমি আমার খতিয়ানি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছি। এবিষয়ে কারো কথা বলার অধিকার নেই। জমির মালিকের অনুমতি ছাড়া কারো মাটি কাটার বিষয়টি আমার জানা নেই। এবিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবি বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, যারা দলীয় নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করবে; সে যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, এর আগে বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মাটি কাটার সঙ্গে জড়িতদের আটক ও জরিমানা করা হয়েছে। জোর করে মাটি কাটার অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।