চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
সিডিএ বলেছে, শতবর্ষী তো দূরের কথা, ৫০ বছর বয়সী কোনো গাছও কাটা হবে না। অল্পবয়সী এবং ছোট আকৃতির ৪৬টি গাছ কাটা হবে। এর বিকল্প বের করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল উল্লেখ করে সিডিএর প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান বলেন, কিন্তু আর কোনো বিকল্প নেই। প্রকল্পের সুফল পেতে হলে ছোট আকৃতির ৪৬টি গাছ সেক্রিফাইস করতে হবে। আমরা র্যাম্পের পাশে এবং খালি জায়গায় শত শত গাছ লাগাব।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের জন্য টাইগারপাস থেকে কদমতলীমুখী শহরের সুন্দর দোতলা রাস্তাটির মাঝের শতবর্ষী গাছ কাটা পড়ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আন্দোলন শুরু করে। তারা সতর্ক করে দেয়, সিআরবিতে কোনো থাবা লাগাতে দেওয়া হবে না। একটি গাছও কাটতে দেওয়া হবে না।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও সরেজমিনে পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা দোতলা রাস্তা অক্ষুণ্ন রাখা এবং এক রাস্তা থেকে অপর রাস্তায় যাওয়ার বিদ্যমান সিঁড়িটি রক্ষা কিংবা নতুন করে নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে গেছেন।
জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত। সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসে টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ফ্লাইওভার চালু করার কথা রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে মোট ১৫টি র্যাম্প রয়েছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টের সাথে কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। র্যাম্প নির্মিত না হলে শহরের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে এই প্রকল্প গুরুত্ব হারাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ১৫টি র্যাম্পের মধ্যে জিইসি মোড়ে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলা, সিইপিজেড ও কেইপিজেড পয়েন্ট দুটি করে নির্মিত হবে। টাইগারপাসে আমবাগান রাস্তার সাথে সংযুক্ত র্যাম্পটি নির্মিত হয়েছে। জিইসি মোড়ে র্যাম্প নির্মাণের পাইলিং শুরু হচ্ছে। টাইগারপাস মোড় থেকে কদমতলীর দিকের রাস্তার র্যাম্পটি নির্মাণে সয়েল টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এই র্যাম্প নির্মাণের সময় বিপুল সংখ্যক গাছ কাটার বিষয় সামনে এসেছে। সিডিএ বনবিভাগের কাছ থেকে ৪৬টি গাছ কাটার অনুমোদন নিয়েছে। একই সাথে রেলওয়ের ১৪ শতক জায়গা ব্যবহারের জন্য অনুমতি চেয়েছে। বনবিভাগের পক্ষ থেকে শহরের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা হিসেবে খ্যাত ওই সড়কটির পার্শ্বস্ত শতবর্ষী গাছসহ অনেকগুলো গাছ মার্কিং করা হয়েছে। গাছের গায়ে সাদা ও লাল কালির মার্কিং দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি প্রতিবাদ শুরু হয়। যেকোনো মূল্যে এই গাছ রক্ষার অঙ্গীকার করেন পরিবেশবাদীরা।
গাছ কাটার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম যখন সোচ্চার, তখন সিডিএ থেকে বলা হয়, র্যাম্পের জন্য শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ৫০ বছর বয়সী কোনো গাছও কাটা হবে না। ৫–৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২০ বছর বয়সী ৪৬টি গাছ কাটা হবে। শতবর্ষী একটি গাছের ঢাল ছেঁটে দেওয়া হবে। র্যাম্প নির্মাণের পর পাশের খালি জায়গায় অন্তত হাজারখানেক গাছ লাগানো যাবে। সিডিএ গাছ লাগিয়ে দেবে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই র্যাম্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিউ মার্কেট থেকে রেয়াজউদ্দিন বাজার, রেলওয়ে স্টেশনসহ পুরো এলাকার মানুষের এক্সপ্রেসওয়ের ব্যবহার এই র্যাম্প নিশ্চিত করবে। তাই র্যাম্পটিকে গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু সিআরবির মতো জায়গায় কিছু গাছ কাটা পড়ছে দেখে আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছি, পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু এর থেকে ভালো কোনো সলিউশন করতে পারিনি।
তিনি বলেন, দোতলা এই সড়কের যেখানে উপর থেকে নিচে নামার সিঁড়ি রয়েছে সেখান থেকে র্যাম্প শুরু হবে। র্যাম্পটি বিদ্যমান নিচের রাস্তার কিছু অংশ এবং খালি জায়গা থেকে নিচের দিকে কিছু অংশ নিয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে রাস্তার কিছু জায়গা যেহেতু র্যাম্পে চলে যাবে, সেক্ষেত্রে নিচের রাস্তার ফুটপাতকে রাস্তা বানিয়ে ফেলবে। রাস্তার পাশে রেলওয়ে থেকে জায়গা নিয়ে আমরা হাঁটার জন্য ফুটপাত করে দেব। ওই ফুটপাতের পাশেও প্রচুর গাছ।
তিনি বলেন, উপরের দিকে যে খালি জায়গা রয়েছে তার নিচের অংশটি আমরা র্যাম্প বানাব। ওখানে কয়েক সারি গাছি রয়েছে। এর মধ্যে একেবারে নিচের সারির অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কমবয়সী ৪৬টি গাছ কাটা পড়বে। বড় এবং শতবর্ষী গাছগুলো পুরোপুরি অক্ষত থাকবে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলাম। আমরাই প্রথম এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ওই হাসপাতালকে প্ল্যান দিইনি। শুরু থেকে আমাদের অবস্থান শক্ত রেখেছিলাম। সিডিএ সিআরবি রক্ষার জন্য, সিআরবির গাছ রক্ষার জন্য অনেক প্রভাবশালীর তদবিরেও ওই হাসপাতালকে প্ল্যান দেয়নি, সেই সিডিএ কী করে শতবর্ষী গাছগুলো কেটে ফেলবে? তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, শতবর্ষী গাছগুলো চট্টগ্রামের সম্পদ। এগুলোকে কোনোভাবেই নষ্ট করা হবে না, করতে দেওয়া হবে না।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বড় কোনো গাছ কাটা পড়বে না। শুধু টাইগারপাস মোড়ের কাছে একটি শতবর্ষী গাছের এক পাশের কিছু ঢাল ছেঁটে দেওয়া হবে। যে ৪৪টি গাছ কাটা হবে সেগুলোর অধিকাংশের বয়স ৪–৫ বছর। কয়েকটির বয়স সর্বোচ্চ ১৫ বছর হতে পারে। ৪৪টি গাছ কাটলেও আমরা ওই এলাকায় এক হাজারের বেশি গাছ লাগাব।
ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজ বলেন, সিআরবির সৌন্দর্যহানি হয় এমন কিছু সিডিএ করবে না। আমরা যেভাবে র্যাম্প নির্মাণ করছি তাতে শহরের এই সুন্দর রাস্তাটি আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। দোতলা রাস্তাটিকে তিনতলা রাস্তার মতো মনে হবে।
সিডিএর গাছ কাটা প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, প্রকল্প পরিচালক এবং পরামর্শক আশ্বস্ত করেছেন যে, কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ৪৪টি ছোট আকৃতির গাছ কাটতে হবে। সরেজমিনে গিয়ে আর কোনো বিকল্প আছে কিনা তা দেখবেন জানিয়ে তিনি বলেন, উন্নয়ন, যোগাযোগ এবং গতিশীলতার স্বার্থে কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন গতকাল মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তারা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেওয়া হয়।
গাছ কাটার বিরোধিতায় মাঠে নামা একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, সিডিএর নতুন করে গাছ লাগানোর আশ্বাসে আস্থা রাখা যায় না। তারা বহু পাহাড় কেটেছে, গাছ কেটেছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখার কোনো নজির নেই। তারা র্যাম্পের ডিজাইন পাল্টে পলোগ্রাউন্ড বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল ও পলোগ্রাউন্ড কলোনির মাঝখানে জায়গাটি নির্ধারণ করতে পারে। জায়গাটি খালি এবং ওখানে একটি উঁচু নিচু রাস্তা রয়েছে। কিন্তু কোনো গাছ নেই। কদমতলী উপরের মোড় থেকে সোজা আসা সড়কে কোনো বাঁক না করে যদি ভিতরের রাস্তা বরাবর প্রস্তাবিত র্যাম্পটি বের করা যায়, তাহলে গাছের পাশাপাশি এই আইকনিক রোডটা রক্ষা পাবে। প্রাইমারি স্কুলটির সামনে দিয়ে অনায়াসে র্যাম্পটি নিয়ে টাইগারপাসে এক্সপ্রেসওয়ের সাথে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। অপরদিকে দেওয়ানহাট ফ্লাইওভারের সাথে যদি এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করে দেওয়া যায় তাতেও ‘বিশাল জনগোষ্ঠীর’ প্রয়োজন মিটবে।