ই্ংরেজী খ্রীষ্টমাস (ঈযৎরংঃসধং) শব্দটি খ্রীষ্টের মাস (উৎসব) শব্দবন্ধটির যুগ্ম অর্থ থেকে উৎসারিত। শব্দটির বুৎপত্তি ঘটে মধ্য ইংরেজী ঈযৎরংঃবসধংংব ও আদি ইংরেজী ঈৎরংঃবং সধবংংব শব্দ থেকে। সবশেষে শব্দটির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৩৮ খ্রীষ্টাব্দের একটি রচনায়। ঈৎরংঃবং শব্দটি আবার গ্রীক ঈযৎরংঃড়ং এবং সধবংংব শব্দটি ল্যটিন সরংংধ (পবিত্র উৎসব) শব্দ থেকে উদগত। প্রাচীন গ্রীক ভাষায়ী (চি) হল ঈযৎরংঃ বা খ্রীষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। এই অক্ষরটি ল্যাটিন অক্ষরী এর সমরূপ। ষোড়শ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে তাই এই অক্ষরটি খ্রীষ্ট শব্দের নাম সংক্ষেপে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়ে। এই কারণে খ্রীষ্টমাসের নাম সংক্ষেপ হিসেবে (এক্সমাস)ঢ’সধং কথাটি চালু হয়।আকাডেমী বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে, যীশু খ্রীষ্টের জন্মউৎসব খ্রীষ্টমাস উৎসবটিকে বংলায় “বড়দিন” আখ্যা দেওয়ার কারণটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে;“২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ: বড় হতে আরম্ভ করে।”খ্রীষ্টিয় বিশ্বাস অনুসারে বড়দিন হল যীশু খ্রীষ্টের জন্মোৎসব। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে সেই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।“অতএব প্রভু নিজে তোমাদেরকে একটি চিহ্ন দেবেন; দেখ, এক জন কুমারী কন্যা গর্ভবতী হয়ে পুত্র প্রসব করবে ও তাঁর নাম ইম্মানূয়েল [আমাদের সঙ্গে ঈশ্বর] রাখবে” (যিশাইয় ৭:১৪)। এবং যিশাইয় ৯:৬ পদে বলা হয়েছে-“কারণ একটি বালক আমাদের জন্য জন্মেছেন, একটি পুত্র আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে; আর তাঁরই কাঁধের উপরে কর্তৃত্বভার থাকবে এবং তাঁর নাম হবে ‘আশ্চর্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা,শান্তির রাজা’।” যীশু খ্রীষ্টের জন্ম কাহিনী বড়দিন উৎসবের মূলভিত্তি। স্বামী যোষেফের সাহচর্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মরিয়ম যীশু খ্রীষ্টের জন্ম দেন। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের পর তাঁকে একটি যাবপাত্রে রাখা হয়েছিল। লুক ২:৭ আয়াতে বলা হয়েছে-“আর তিনি তাঁর প্রথমজাত পুত্র প্রসব করলেন; এবং তাঁকে কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে রাখলেন, কারণ পান্থশালায় তাঁদের জন্য কোন স্থান ছিল না।” প্রচলিত ধারনা অনুসারে, এটি বেথলেহেমের চার্চ অব দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে।পবিত্র বাইবেল অনুসারে যীশু খ্রীষ্টের জন্মের পর কয়েক জন পন্ডিত স্বর্ণ,সুগন্ধিতেল ও ধুপ উপহার হিসেবে শিশু যীশুকে দেখতে যান। ধারণা করা হয়, এই পন্ডিতগন ইরানের কান উচ্চ শিক্ষিত ধর্মীয় গোত্রের কোন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন এবং তারা ছিলেন ‘জরোয়্যাসট্রিয়ানিজম’ ধর্মের পুরোহিত নতুবা জ্যোর্তিবিজ্ঞানী। তারা জ্যোর্তিবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। অনেকে মনে করেন, পূর্বদেশী এই শিক্ষিত জ্ঞানী লোকেরা ছিলেন দার্শনিক, এক বৃহৎ ও প্রভবিশালী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যাদের আওতায় ছিল জাতির অধিকাংশ ধন ও বিদ্যা। আবার অনেকে ছিলেন সিদ্ধ, যারা ঈশ্বরের দুরদর্শীতার লক্ষন সমুহ অধ্যায়ন করতেন এবং সততা ও জ্ঞানের জন্য লোকদের কাছে ছিলেন সমাদৃত। এরূপ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন কয়েকজন পন্ডিত যারা যীশুর কাছে উপহার নিয়ে এসছিলেন। প্রাচ্যদেশ ছিল বহুমূল্য দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ, আর জ্ঞানী পন্ডিতেরা রাজার খোঁজে শূন্য হাতে যাত্রা করেননি। তখনকার রীতি অনুসারে রাজা ও উচ্চপদস্থ বিশেষ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন উপহার তাদের সামনে উপস্থিত করা হতো। পন্ডিতেরা তিনটি উপহার নিয়ে রাজাধিরাজকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য গিয়েছিলেন,বর্ণ-কুন্দুরু-গন্ধরস’ (মথি ২:১১)। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দুটি সত্য প্রকাশিত হয়েছে-প্রথমত: যীশু সমস্ত মানব কুলের রাজকীয় সম্মানের যোগ্য। দ্বিতীয়ত: পরজাতি এবং যিহুদী সকলেই ঈশ্বরের উদ্ধারমুলোক পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।খ্রীষ্টিয়ানরা নানাভাবে বড়দিন উৎসব পালন করে থাকে। বড়দিন উৎসব পর্বের অন্যতম অঙ্গ হল গৃহসজ্জা, ক্যারল, উপহার আদান প্রদান ও মন্ডলীতে উপাসনা ও প্রার্থনায় যোগ দেওয়া। বড়দিন উপলক্ষ্যে বিশেষ ধরনের সাজ সজ্জার ইতিহাসাট অতি প্রাচীন। প্রাক খ্রীষ্টিয় যুগে, রোমান সাম্রাাজ্যের অধিবাসী শীতকালে হরিৎ বৃক্ষের শাখা প্রশাখা বাড়ির ভিতরে এন সাজাতো। খ্রীষ্টিয়ান এই জাতীয় প্রথাগুলিকে তাদের সৃজ্যমান রীতিনিতীর মধ্যে স্থান দেয়। পঞ্চদশ শতাব্দির লন্ডনের একটি লিখিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই সময়কার প্রথা অনুসারে খ্রীষ্টমাস উপলক্ষ্যে প্রতিটি বাড়ি ও সকল গ্রামীন মন্ডলী “হোম, আইভি ও বে এবং বছরের সেই মৌসুমের যা কিছু সবুজ, তাই দিয়েই সুসজ্জিত করে তোলা হতো। প্রচলিত খ্রীষ্টিয় বিশ্বাস অনুসারে, হৃদয়াকার আইভিলতার পাতা মর্ত্যে যীশু খ্রীষ্টের আগমনের প্রতীক; হলি প্যাগান (নন-খ্রীষ্টিয়ান, পৌত্তলিক) ও ডাইনিদের হাত থেকে রক্ষা করে; এর কাঁটার ক্রুশবিদ্ধকরনের সময় পরিহিত যীশু খ্রীষ্টের কন্টকমুকুট এবং লাল বেড়িগুলি ক্রুশে যীশু খ্রীষ্টের রক্তপাতের প্রতীক। খ্রীষ্টমাস বৃক্ষ ও চিরহরিৎ শাখাপ্রশাখার ব্যবহার দক্ষিন অয়নান্তককে ঘিরে প্যাগান প্রথা ও অনুষ্ঠানগুলির খ্রীষ্টিয়করনের ফলশ্রæতি; এক ধরনের প্যাগান বৃক্ষপূজা অনুষ্ঠান থেকে এই প্রথাটি গৃহীত হয়েছেল। ই্ংরেজী ভাষায় "ঈযৎরংঃসধং ঃৎবব" শব্দটির প্রথম লিখিত উল্লোখ পাওয়া যায় ১৮৩৫ খ্রীষ্টিাব্দে, শব্দটি গৃহীত হয়েছিল জার্মান ভাষা থেকে। মনে করা হয়, আধুনিক খ্রীষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটির সূচনা ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর এবং জার্মানিতে। যদিও অনেকের মতে, এই প্রথাটি ষোড়শ শতাব্দীতে মার্টিন লুথার চালু করেছিলেন। প্রথমে তৃতীয় জর্জের স্ত্রী রাণী শার্লোট এবং পরে রাণী ভিক্টরিয়ার রাজত্বকালে আরো সফলভাবে প্রিন্স অ্যালবার্ট জার্মানিন থেকে ব্রিটেনে এই প্রথাটির আমদানি কারেন। ১৮৪১ খ্রীষ্টিাব্দ নাগাদ খ্রীষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটি সমগ্র ব্রিটেনে যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। ১৮৭০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্টের জনগনও খ্রীষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটি গ্রহন করে। খ্রীষ্টমাস বৃক্ষ আলোকসজ্জা ও গহনা দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে পোইনসেটিয়া নামে একটি দেশজ বৃক্ষ খ্রীষ্টমাস প্রথার সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যান্য জনপ্রিয় হলিডে গাছ হলো হলি, মিসলটো, লাল অ্যামারিলিস ও খ্রীষ্টমাস ক্যাকটাস। খ্রীষ্টমাস বৃক্ষের সঙ্গে মমালা ও চিরসবুজ পত্রসজ্জায় সজ্জিত এই সব গাছ দিয়েও বাড়ির অভ্যন্তর সাজানো হয়ে থাকে।বড়দিন উৎসবে আরেকটি অন্যতম আনন্দের বিষয় হল উপহার আদান প্রদান। বিশ্বের অনেক দেশেই বড়দিন হল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান প্রদানের মৌসুম। বড়দিন ও উপহার আদান প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রীষ্টিয় ও পৌরানিক চরিত্রের উদ্ভবের সঙ্গেও বড়দিন উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্তভ এঁরা হলেন ফাদার খ্রীষ্টমাস বা সান্টাক্লজ, পেরে নোয়েল, ওয়েনাকসম্যান; সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাস; ক্রাইস্টকাইল্ড; ক্রিস ক্রিঙ্গল; জৌলুপুক্কি; বাব্বো নাতালে; সেন্ট বাসিল; এবং ফাদার ফরেস্ট। আধুনিক কালে এই চরিত্রগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হলো লাল পোশাক পরিহিত পৌরাণিক উপহার প্রদানকারী সান্টাক্লজ। সান্টাক্লজের উৎস একাধিক। সান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ; যার সাধারন অর্থ সেন্ট নিকোলাস। খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতাব্দির নিকোলাস ছিলেন অধুনা তুরস্কের মিরার বিশপ। অন্যান্য সন্তসুলভ আবদানগুলির পাশাপাশি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। অনেক দেশে তাঁর সম্মানে ৬ ডিসেম্বর উপহার আদান প্রদানের মাধ্যমে উৎসব পালিত হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বিশপের পোশাক পরিহিত নিকোলাস তাঁর সহকালীদের সহায়তায় বিগত এক বছরে শিশুদের আচরণের খোঁজখবর নিতেন; তারপর স্থির করতেন সেই শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য কিনা। খ্রীষ্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সেন্ট নিকোলাসের নাম নেদারল্যান্ডে পারিচিতি লাভ করে এবং মধ্য ও দক্ষিন ইউরোপে তাঁর নামে উপহার আদান প্রদানের ঐতিহ্য চালু হয়ে যায়। যদিও সংস্কার আন্দোলনের সময় অনেক প্রোটেস্টান্ট উপহার প্রদানকারীর চিরাচরিত এই চরিত্র বর্জন করে এবং অনেকে ভিন্নমত পোষন করে থাকে।আমরা যা কিছু চিন্তা করি যীশু খ্রীষ্টের জন্মের তাৎপর্যের বিষয়টি যেন ভুলে না যাই। ঈশ্বর আমাদেরকে তাঁর সবয়েছে মূল্যবান জিনিস, তাঁর একমাত্র পুত্র যীশু খ্রীষ্টকে আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তিনি আমাদের সকলের জন্য ক্রুশে রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন এবং তৃতীয় দিনে আবার পুনরুত্থিত হয়েছেন। তিনি আামাদের জন্য পরিত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন। “শাস্ত্র অনুসারে খ্রীষ্ট্ আমাদের পাপের জন্য প্রাণ দিলেন ও তাঁকে কবরস্থ করা হল, আর শাস্ত্রানুসারে তিনি তৃতীয় দিনে উত্থাপিত হয়েছেন” (১ করি ১৫:৩-৪)। এবারের বড় দিনে আপনি ঈশ্বরকে দেবার জন্য কি প্রস্তুত করেছেন? আপনি সুন্দর খ্রীস্টমাস ট্রি দিয়ে এবং আলোক সজ্জা করে ঘর সাজিয়েছেন? অনেক অর্থ তাঁর জন্য ব্যয় করবেন, কয়েকশত ডলার উৎসর্গ করবেন? কিন্তু এটি শুধুমাত্র বানিজ্যিক লেনদেনে সক্রিয় হতে পারে। আপনি অনেককে দাওয়াত দিয়ে বিরাট ভোজের আয়োজন করেছেন? অনেককে সুন্দর সুন্দর উপহার দিবেন? সবই ভাল পরিকল্পনা-সব কিছুই ভাল, কিন্তু যথেষ্ট নয়।