মাছে ভাতে বাঙালি। ইলিশ বাঙালির জাতীয় মাছ। প্রতি বছরেরই একটা পূর্ব ঘোষিত নির্ধারিত সময়কে ইলিশের প্রজনন মৌসুম হিসাবে দেশব্যাপি সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেই নির্ধারিত সময়ে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের স্বার্থেই দেশের যে কোন প্রান্তে যে কোনো প্রকার ইলিশ মাছ আহরণ, বিক্রয় ও পরিবহন সরকারিভাবে সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ ঘোষিত। সে মর্মে নির্ধারিত সময়ের পুর্বেই মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারি নির্দেশনার প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং জনসচেতনামূলক প্রচারণাও চালানো হয়। এমনকি এ সময়ে দেশের জেলে সম্প্রদায়ের পরিবার গুলোর স্বাভাবিক জীবনযাপনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জেলেদের মদ্ধে সরকারিভাবে ভর্তুকি প্রদানের বিধান জারি রয়েছে। তবে সরেজমিনে দেখা মিলছে ভিন্ন চিত্র।এ সময়ে ইলিশ আহরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও ফরিদপুরের পদ্মা নদীবেষ্টিত বিভিন্ন বাজারে ও বাজার সংলগ্ন এলাকায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে অবৈধভাবে শিকার করা বিভিন্ন সাইজের ইলিশ মাছ। অধিকাংশ ইলিশেরই পেট ভর্তি ডিম। এমনকি নদী সংলগ্ন অনেককেই বাড়িতে বাড়িতে মজুদ ও সংরক্ষণ করেও ইলিশ বিক্রি করতে দেখা যায়। ক্রেতা সাধারণের মধ্যে চাহিদা থাকায় বেশ চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে অবৈধভাবে আহরিত এই ইলিশ এবং প্রতিনিয়ত উল্লেখযোগ্য ক্রেতার সমাগমও দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চল গুলোতে। বাজার বা বাজার সংলগ্ন বিভিন্ন বাড়ি থেকে চাহিদা অনুযায়ী মাছ কিনছেন ক্রেতারা।সরেজমিনে ফরিদপুরের পদ্মা নদী সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানভেদে ২০০-৪০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকায়। ৪০০-৭০০গ্রাম সাইজের মাছের দাম প্রতি কেজি ৮০০-১০০০ টাকা। আর ৮০০ গ্রাম -১ কেজি সাইজের মাছগুলো ১০০০-১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন, ডিগ্রিরচর ইউনিয়ন, চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ের ন্যায় প্রকাশ্যেই ইলিশ বিক্রি করতে দেখা যায়। বাজার সংলগ্ন অনেকেই বাড়িতে সোলার বাক্সে (ককসিট) বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে দিন-রাত্রিময় ইলিশ বিক্রির রমরমা মৌসুমি ব্যবসার স্বাধ নিচ্ছেন।ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষিত সময়ের প্রথমদিকেবেশ ঢিলেঢালা ভাবেই চলছিলো মৎস্য অধিদপ্তর ফরিদপুর এর প্রশাসনিক তৎপরতা। তাই ইলিশ আহরণকারি জেলেরাএকপর্যায়ে প্রকাশ্যেই বিক্রি শুরু করে ইলিশ। এমনকি স্বাভাবিক সময়ের ন্যায় নদী সংলগ্ন স্থানীয় বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বেশ কিছু ফলপ্রসু অভিযানপরিচালনা করা হয় এবং ইলিশ মাছ সহ বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা জাল জব্দ ও বিনষ্ট করা হয়।উন্মুক্ত বাজারে ইলিশ বিক্রির সত্যতা মিলেছে প্রশাসনের অভিযানেও। গত ২৮ অক্টোবর সোমবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর সদর উপজেলার চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের লাল খা’র বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে পাঁচ মণের অধিক বিভিন্ন সাইজের ইলিশ জব্দ করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফজলে রাব্বী।এসময় এক অসাধু জেলেকে আটক করে ৪ দিনের কারাদণ্ড এবং এক ক্রেতাকে ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। তবে অভিযানের খবরে পালিয়ে যায় অনেক জেলে ও ইলিশ ক্রেতা। ফরিদপুর জেলা প্রশাসন ও মৎস অধিদপ্তরের সমন্বয়ে এ ধরনের একাধিক অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।এ বছর ইলিশ আহরণ নিষেধাজ্ঞা শুরুর প্রথম দিকে প্রশাসনিক অভিযানের শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এতে করে বেপরোয়া হয়ে উঠে কিছু কিছু জেলে। একপর্যায়ে এসে প্রশাসনের অভিযান থাকা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞা মানছেন না জেলেরা।এ বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় জেলেদের সাথে কথা বলেন সরেজমিন প্রতিবেদক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নর্থ চ্যানেল ও চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের একাধিক জেলে বলেন, আমার সরকারি ভাতা কার্ড আছে, তয় আমরা কোনো সাহায্য পাই নাই তাই মাছ ধরি! বউ বাচ্চা নিয়া কি না খাইয়া মইরা যামু ?তবে এসব অঞ্চলের জেলেদের অনেকেরই নেই মৎস্যজীবী কার্ড। তাই বাধ্য হয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাদেরকে অবৈধভাবে মাছ শিকারে নামতে হয় বলে তারা জানান। এ সময় মাছ ধরা বেআইনি এবং এজন্য তাদেরকে শাস্তির আওতায় আসতে হতে পারে এটা মেনে নিয়েই বাধ্য হয়ে তারা মাছ শিকার করেন।এক প্রবীণ জেলে আক্ষেপ করে বলেন, আমি প্রায় চল্লিশ বছর নদীতে মাছ ধইরা-বেইচাই পরিবার নিয়া খাইয়া-পইরা বাইচা আছি। আমিই তো একটা ভাতা কার্ড পাইলামনা ! জেলেদের দাবি, মৎস্যজীবী হিসেবে সরকারি ভাতাভোগীদের তালিকায় নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য দীর্ঘদিন যাবত চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন । অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া থাকলেও এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি নাম। তাই পাচ্ছেন না কোন সরকারি সাহায্য সহযোগিতা।জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা জানান, সরকারিভাবে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন বাজার এবং জেলে নৌকা থেকে অবৈধভাবে শিকার করা মাছ ও জাল জব্দ করা হয়। এপর্যন্ত প্রায় দুই লাখ মিটার জাল জব্দ করে নষ্ট করা হয়েছে এবং কয়েক মন জব্দকৃত মাছ বিভিন্ন এতিমখানা-মাদ্রাসায় ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অসাধু জেলেদের কে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। জেলেদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য ও সরকারি সহায়তা ভাতার কার্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ইতিপূর্বে যখন জেলেদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয় তখন অনেকেই আগ্রহ করে এগিয়ে আসেননি। নতুন করে নাম তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান। পর্যায়ক্রমে সকল মৎস্যজীবীকেই ভাতা কার্ডের আওতায় আনা হবে। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার প্রবণতা অনেক। আমরা প্রতিনিয়ত জেলেদেরকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছি।জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগনের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন অভিযানকালে জব্দকৃত মাছগুলো কখনো কখনো জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এনে রাখা হয় এবং বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানার কর্মকর্তাদের ডেকে এনে তাদের মাঝে বিতরণ করা হয় এবং জব্দকৃত জালগুলো নিরাপদ স্থানে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয় বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়।এই প্রজনন মৌসুমে ইলিশের অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে ইলিশ মাছ না ধরার জন্য জেলেদের প্রতি আহ্বান জানান এবং আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।