রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের মোহর গ্রামে চাষের আঙিনায় নীরব এক বিপ্লব—গরুর বদলে ঘোড়া দিয়ে মই চালিয়ে জমি সমতল করছেন স্থানীয় কৃষকেরা। গরু পালনের ক্রমবর্ধমান খরচ আর সংকটে ঘোড়া হয়ে উঠেছে তাদের নতুন ভরসা। গরু পালতে ঘাস, খাবার, চিকিৎসা—সবকিছুর পেছনেই এখন ব্যাপক ব্যয়। ঘোড়া তুলনামূলক কম খায়, শক্তিশালী, আবার কাজও শেষ করে দ্রুত, জানালেন উদ্যোগের পথিকৃৎ কৃষক মো. নাসির। বিকল্প ভাবনা থেকে জন্ম নিল ‘ঘোড়া-মই’ মো. নাসির অন্যর ২ বিঘা জমিতে প্রথম ঘোড়াকে জোয়ালবিহীন শক্ল দিয়ে সংযুক্ত করেন। শুরুতে প্রতিবেশীদের কৌতূহল আর হাসি পেলেও প্রথম মৌসুমেই ২৫ শতাংশ শ্রম ও খাদ্যব্যয় কমেছে—এমনই দাবি তাঁর। কৃষক মিলন বললেন, “একটা বড়সড় গরু কিনতে এখনই লাখ টাকার ঘরে ঢুকতে হয়। ঘোড়া দিয়ে জমি টানলে একই কাজের খরচ অর্ধেকে নামে, সময়ও বাঁচে।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদ এ উদ্যোগকে “ব্যয় সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব” আখ্যা দিয়ে বলেন,গরুর চেয়ে ঘোড়া প্রতি কিলোমিটার কাজ করতে কম ফিড নিয়ে বেশি শক্তি দেয়। আমরা মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক পরিমাপ শুরু করেছি। সফল হলে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হবে।
তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত সালমান জানান, মোহর গ্রাম ও আশপাশে ঘোড়া দিয়ে মই চাষে উদ্বুদ্ধ কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। কৃষকের খরচ কমাতে ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এ উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়,”— মন্তব্য তাঁর।
ঘোড়া দিয়ে মই টানার দৃশ্য মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি হয়ে ফেসবুক-টিকটকে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আগ্রহী দর্শনার্থীদের দলে ভিড় লেগেই আছে; কেউ কেউ ঘোড়া-মই চালিয়ে দেখতেও চাইছেন।খরচের সঞ্চয়: গরুর বাজারদর ১৫–২০ গুণ বেশি, চিকিৎসা-খাদ্য-দৈনিক রক্ষণাবেক্ষণ মিলিয়ে বছরে গড়ে ৪০–৫০ হাজার টাকা সাশ্রয় সম্ভাব্য।কর্মক্ষমতা: ঘোড়া প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩–৪ বিঘা জমি মই টানতে পারে—গরুর প্রায় দ্বিগুণ।
চ্যালেঞ্জ: উপযুক্ত জুতো (horseshoe), প্রশিক্ষণ ও খাটে-চাকার উপাদান মানসম্মত না হলে ঘোড়ার পায়ের ক্ষতি হতে পারে।সরাসরি জোয়াল নয়—লম্বা কাঠের হাতা ও কোমর-পট্টি দিয়ে ঘোড়াকে যুক্ত করা হয়।
হাতলভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ—কৃষক পেছনে দাঁড়িয়ে মইয়ের ভারসাম্য ঠিক রাখেন। উন্নত মইপাট—পিছনে ভারী কাঠের বদলে হালকা লৌহ / বাঁশের ফ্রেম, যাতে কম টানেই সমান চাষ। কৃষি বিভাগ বলছে, মাঠপর্যায়ের ফল ভালো এলে ‘ঘোড়া-মই’-কে পাইলট প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সরকারি ঋণ, প্রশিক্ষণ ও ঝুঁকিহ্রাস বীমা অন্তর্ভুক্তির ভাবনা চলছে। মোহর গ্রাম যেন বদলে যাচ্ছে স্বল্প খরচে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে—কৃষকের প্রাণ, জমির প্রাণ, আর নতুন দিগন্তের সূচনা। এখন দেখার বিষয়, এই বিকল্প পদ্ধতি রাজশাহী ছাড়িয়ে সারাদেশের ছোট-বড় চাষাবাদে কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।