চায়ের নগরী শ্রীমঙ্গল। তবে চায়ের পাশাপাশি এখানকার আনারসের খ্যাতি রয়েছে সারা দেশে। দেশের চাহিদা পূরণে সবচেয়ে বেশি আনারস আম কাঠাল সহ বিভিন্ন ফল উৎপন্ন হয় শ্রীমঙ্গলে। এখানকার আনারস দেশজুড়ে সুপ্রসিদ্ধ যা স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। এই ঋতুতে বাজারজুড়ে অন্য ফলের সাথে শ্রীমঙ্গলের আনারসও আধিপত্য বিস্তার করছে। এবারও জেলায় ১২৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হলেও শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রায় ৪২০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ করা হয়েছে। বাম্পার ফলন হওয়ায় দাম গত বছরের তুলনায় এবার অনেক কম।
এ অঞ্চলের চাষিরা জানান, শ্রীমঙ্গলে পাহাড়ি উঁচু-নিচু টিলায় ষাটের দশক থেকে আনারস চাষ শুরু করা হয়। এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু আনারস চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে বারো মাস আনারসের চাষ করা হয়। নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয় শ্রীমঙ্গলের আনারস। আনারস একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলও বটে। সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে আনারস চাষ হয়। তবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে উৎপাদিত আনারস দেশখ্যাত।
এখানে দিগন্তজোড়া সবুজ চা বাগান আর পাহাড় এরই মধ্যে রয়েছে আনারস বাগান। চায়ের রাজ্যে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে আনারসের সারি সারি বাগান। এই আনারসের গাছগুলো নিচ থেকে টিলার উপরে এমন ভাবে গিয়ে উঠেছে দূর থেকে মনে হবে যেন একদল পিপিলিকা ডানা মেলে সারি বেঁধে উপরে উঠছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, মে থেকে জুন পর্যন্ত আনারসের ভরা মৌসুম। এ বছর মৌলভীবাজার জেলার প্রায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এ অঞ্চলে হানিকুইন ও জাইনকিউ নামের আনারসের উৎপাদন হয়ে আসছে বলে জানান কৃষি বিভাগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই শত শত ঠেলা, জিপ ও পিকআপে করে নিয়ে আসে শ্রীমঙ্গলের আড়ৎগুলোতে। এই উপজেলার বিষামণি, মাইজদিহি, হোসেনাবাদ, এমআর খান, নন্দরানী, বালিশিরা, নূরজাহান, ডলুছড়া, সাতগাঁও, মোহাজেরাবাদসহ প্রতিটি এলাকা থেকে প্রচুর আনারস আসে বাজারে। বাজারে আসা ঠেলাগাড়ি গুলোর সামনের দিক মাটিতে মুখ দিয়ে তার পিঠে রাখা আনারসকে ডিসপ্লের মতো করে সাজিয়ে রাখা হয়। যেন দূর-দূরান্ত থেকে ছোট-বড় আড়ৎদার ও পাইকারি-খুচরা ক্রেতারা এগুলো দেখে সহজে আকৃষ্ট হন। আর এখান থেকেই আনারস যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গাড়ি অনুপাতে একেকটা ঠেলাগাড়িতে একশ পঞ্চাশ থেকে ৫০০ পিস আনারস সুন্দর করে ডিসপ্লে করে রাখা হয়। সে গুলো সাইজ অনুযায়ি বিক্রি হয়ে থাকে।
এছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা কমলগঞ্জ, চুনারুঘাট এমনকি বাহুবল থেকেও আনারস আসে শ্রীমঙ্গলের বাজারে। বাগান মালিক ও আড়ৎদারদের তথ্য মতে বাজারের ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন আড়ৎদার রয়েছেন। যাদের কাছে বাগান মালিকগন তাদের আনারস বিক্রির জন্য দিয়ে থাকেন।
আশিক বাণিজ্যালয়ের আড়তদার মো. আশিকুর রহমান বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবার আনারসের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। আমরা ৬ মাস যাবৎ মৌসুমি এই সিজনের আনারস বিক্রি করছি। এবারের আনারসের স্বাদ-গন্ধ অনেক মজার এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনেক হওয়াতে আমরা দামও ভালো পাচ্ছি।
মেসার্স মনজুর আলী আড়তদার অভিযোগ করে মো. মছর উদ্দিন বলেন, আনারসের ফলন ভালো হয়েছে কিন্তু আনারস সংরক্ষণের অভাবে পঁচে যাচ্ছে। পুক্ত আনারস বেশি দিন বাগানে রাখা যায় না, বৃষ্টি হলে সেই আনারস বাগানেই পঁচে যায়। সে জন্য আনারস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
আনারস কিনতে আসা পারভেজ, জায়েদ ও সাইদুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলের আনারস খুব সু-স্বাদু। তাই পাশের উপজেলা কমলগঞ্জ থেকে কিনতে আসছেন। এখানে প্রতি আলী (৪পিচ) আনারস ৫০-১২০ টাকা ধরে কিনে নিয়েছেন তারা।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিসার (কৃষিবিদ) মো: আলাউদ্দিন বলেন, এবছর শ্রীমঙ্গলে ৪২০ হেক্টর জমিতে আনারস, ১২৫০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়েছে। আমরা কৃষি অফিস থেকে ২০ জন কৃষককে প্রনোদনা হিসেবে দুই হাজার ২৫০টি আনারসের চারা দিয়েছি। সকল চাষীকে কৃষি অফিস সবসময় ভালো পরামর্শ দিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, আনারসের পাশাপাশি লেবু, নাগামরিচ ও বিভিন্ন ফলের চাষ হয় এ অঞ্চলে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি জানান, বর্তমানে জেলায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হচ্ছে।
তিনি বলেন, এবছর আমাদের এলাকায় প্রচন্ড খরা হয়েছে, যার কারণে হানিকুইন জাতের আনারসগুলো একবারে ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু বিক্রি করার জন্য পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা জুলডুগি আনারস বলে বিক্রি করছে। আমাদের এলাকায় এই আনারস চাষ হয় না। কিন্ত বিক্রেতারা এই নাম বলে বিক্রি করছেন। আনারস ও লেবু সংরক্ষণাগার ও প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।