চায়না দুয়ারী জালের আধিপত্যে ভোলায় বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ

শরীফ হোসাইন প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর , ২০২৫ ১৬:৩৯ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর , ২০২৫ ১৬:৩৯ পিএম
চায়না দুয়ারী জালের আধিপত্যে ভোলায় বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ

 ভোলার জলাশয়গুলোতে বেড়েছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জালের যত্রতত্র ব্যবহার। আর এতে ছোট-বড় সকল প্রকার দেশীয় প্রজাতির মাছ পকেট (স্থানীয় ভাষায়) বা চায়না দুয়ারী জালের আদিপত্যের খপ্পরে পড়ে ক্রমেই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অতি মুনাফালোভী কিছু মানুষের চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহারের কারণে এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পুঁটি থেকে শুরু করে ছোট-বড় কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ। বিলুপ্তি প্রায় এ মাছ সংরক্ষণের জন্য মৎস্য অফিসের নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।
জানা গেছে, বিশেষ করে জৈষ্ঠ্য মাসের দিকে চলে দেশীয় মাছের প্রজনন মৌসূম। আর আষাঢ়ের মুষলধারে বৃষ্টির নতুন পানির টানে পুরনো গভীর জলাশয় ও পুকুরে থাকা দেশীয় মাছগুলো ডিম ছাড়ার জন্য বিলের পানিতে ছুটে আসে। ঠিক এ সময়টাতে একদল অর্থলোভী মানুষ চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে নির্বিচারে শিকার করেন এ মাছগুলো। যার ফলে বিঘিœত হয় মাছের চলাচলের সঠিক প্রবাহ এবং ব্যহত হয় দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধি।
আরো জানা গেছে, ৯০ দশকের দিকেও দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে এ অঞ্চলের ঐতিহ্য ও জৌলুশ ছিলো পুরো জেলাজুড়ে। স্থানীয়রা এ মাছ সংরক্ষণের জন্য বানাতেন বিল সংলগ্ন পুকুর। বিলের মাঝখানে অসংখ্য এই পুকুরগুলোকে স্থানীয় ভাষায় (বিল্যা পুকুর) নামে বলা হতো। এরপরই দিনে দিনে কারেন্ট জাল, কোচ (লোহার তৈরী সুচালো একাধিক কাটা দিয়ে বানানো), বাঁশের তৈরী পলপা (স্থানীয় ভাষায়) ব্যবহার করে মাছ শিকার করায় কমতে থাকে দেশীয় মাছ। মাছ শিকারীরা কম পরিশ্রম ও অধিক মুনাফার আশায় মাছ শিকারের নতুন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে চায়না দুয়ারী জালের। এতে নির্বিচারে নিধন করা হয় দেশীয় মাছ।
ভোলা সরদ উপজেলার মৎস্য চাষী আমির হোসেন বলেন, চায়না দুয়ারী জাল যত্র-তত্র ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশীয় মাছ এখন হারাতে বসেছে। এ জাল ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে, তবেই ভবিষ্যতে দেশীয় মাছ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য সবাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি জেলা মৎস্য অফিসকেও আরো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর এলাকার পুকুর মালিক আব্বাস মিয়া তুলে ধরেছেন চায়না দুয়ারী জালের ভয়াবহতার কথা। তিনি বলেন, গত দুই বছর ধরে এ জালের প্রভাব বেড়েছে। চায়না দুয়ারী জালে একবার যদি মাছ ঢুকে সে আর বেরোতে পারেনা। তিনি আরো বলেন, চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে পুঁটি মাছ থেকে শুরু করে সকল মাছ নিধন করা হয়। আর সে কারণে বিলের পুকুরে এখন আর দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। শুধু ভোলা সদর কিংবা তজুমদ্দিন নয় এমন জালের ব্যবহার পুরো জেলা জুড়ে।
চায়না দুয়ারী জাল প্রতিটি গ্রামের জলাশয় ও বিলগুলোতে যত্র-তত্র চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার চোঁখে পড়ে। কয়েকটি স্থানীয় বাজারে ৬০০০-১০০০০ টাকায় দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এ জাল। এগুলো সাধারণত ১৫ থেকে ২০ মিটার লম্বা এবং দেড় ফুট চওড়া হয়ে থাকে। প্রতি এক ফুট পর পর চারকোণা চিকন লোহার রিং দেওয়া হয়। এর এক মাথায় পকেটের মতো করে রাখা হয়। যেখান দিয়ে একবার মাছ প্রবেশ করলে আর বেরোনোর সুযোগ থাকেনা। এ জালের অন্য মাথায় মাছ বের করার জন্য দড়ি দিয়ে বেধে রাখেন শিকারীরা। পরে জাল উঠিয়ে দড়ি খুলে বের করা হয় মাছ।
মিরাজ নামে দৌলতখানের এক স্কুল শিক্ষক জানান, আগে গ্রামের জলাশয় কিংবা ছোট ছোট খাল এবং নদীতে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে কারেন্ট জালা, চায়না দুয়ারী জালের ব্যাপক হারে ব্যবহারের কারণে ছোট থেকে ছোট এবং বড় মাছ অবাধে শিকার করা হচ্ছে। এতে আমাদের দেশীয় মাছের উৎপাদন চরম আকারে ধ্বংস হচ্ছে। দেশীয় মাছ রক্ষার্থে প্রশাসনকে চায়না দুয়ারী জাল যাতে করে ব্যবহার করতে না পারে সে লক্ষে কাজ করতে হবে।
তজুমদ্দিন উপজেলার আড়ালিয়া এলাকার শিক্ষক মনির হোসেন জানান, ভয়াবহ চায়না দুয়ারী জালগুলোর অবাধ ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবো। তজুমদ্দিন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আমির হোসেন জানান, চায়না দুয়ারী জালগুলো মৎস্য আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা দেশীয় মাছ রক্ষায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, আমরা মাছে-ভাতে বাঙ্গালী। আর এই বাঙ্গালীর দেশীয় মাছ রক্ষায় চায়না দুয়ারী, কারেন্ট জালসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জাল পরিহার করতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা গত ১ সপ্তাহে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী এবং জেলার বিভিন্ন স্থানের দোকানগুলোতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণে চায়না দুয়ারী জাল জব্দ করি এবং পরবর্তীতে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। জেলেরা যাতে করে মাছের উৎপাদন ধ্বংসকারী জাল ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চায়না দুয়ারী জাল সহ অন্যান্য ক্ষতিকর জাল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য মৎস্য বিভাগ থেকে জেলেদের মাঝে প্রতিনিয়তই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo