ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে ‘উক্তিটির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় আজকে যে শিশু, কাল সে শিশুই পরিণত হয়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের, জাতির কর্ণধার হবে এবং তাকে শিশুকাল পেরিয়েই পড়তে হয় কিশোরজীবনে, আর এখানেই জীবনের গতিপথে বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে ‘উক্তিটির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় আজকে যে শিশু, কাল সে শিশুই পরিণত হয়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের, জাতির কর্ণধার হবে এবং তাকে শিশুকাল পেরিয়েই পড়তে হয় কিশোরজীবনে, আর এখানেই জীবনের গতিপথে বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং নামক একটি সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে ২০১০ সালের পর থেকে উল্লেখ্য ২০১৭ সালে ঢাকার উত্তরায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুনের পর এদের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে এবং সঙ্গে সঙ্গেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসে এবং প্রতিরোধে তৎপর হয় ও মাঠে নামে।
রোববার ৩ মার্চ ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধন উপলক্ষে ভাষণ দানকালে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বক্তব্য দানকালে সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে প্রতিটি পরিবারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কারও ছেলেমেয়ে যেন কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে, শুধু গ্রেপ্তার করে লাভ নেই, সচেতন হতে হবে, তাই গোড়া থেকে ধরতে হবে যখন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে তখনই এ সমস্যাটি দেখা দেয়, এটি কোভিড ১৯ চলাকালিন সময়ে বিস্তার করেছে এবং এই সময়ে এটি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে। পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর সারা দেশে সর্বস্তরে এই সমস্যা নিরোধের জন্য ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
পুলিশ বিভাগের নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে ২০১২ সালে যেখানে কিশোর অপরাধে ৪৮৪টি মামলায় ৭৫১ জন আসামি ছিল, সেখানে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসেই ৮২১টি মামলায় ১ হাজার ১৯১ জন শিশু-কিশোর আসামি হয়।
২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ঢাকা ও এর আশপাশে ১২টি এবং সারা দেশে কমপক্ষে ৩৫টি কিশোর গ্যাং ছিল- খবরটি ২০২০ সালে ১৭ নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।
তবে বর্তমানে রাজধানীতে এ ধরনের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ১০০টিরও বেশি এবং সদস্যসংখ্যা চার হাজারের বেশি বলেই জানা যায়, উদাহরণস্বরূপ তেজগাঁওতে ২০টি, মিরপুরে ৩৫টি উত্তরায় ২০টি গুলশানে ৬টি, ওয়ারীতে ছয়, মতিঝিলে ১১, রমনায় আট এবং লালবাগে চারটি গ্রুপ অধিক মাত্রায় সক্রিয় রয়েছে।
রাজধানীর বাইরে সাভারে প্রায় ১৫টি, টঙ্গীতে ৩০টি এবং নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে অপরাধের অভয়ারণ্য বানিয়ে রেখেছে।
ফলে ঢাকায় প্রতি মাসে ১৫-২০টি খুন হচ্ছে দেশে গত ২০ বছরে এ ধরনের কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনই খুন হয়েছে শেষ দুই বছরে, যুগান্তরের তথ্যানুযায়ী সাভারে ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা, বরগুনায় নয়ন বন্ডের দ্বারা রিফাত খুন, বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড আর সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রনেতাদের দ্বারা স্বামীকে আটকে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ইত্যাদি সবই কিশোর গ্যাংয়ের বিষফল।
বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিদিনই দেশজুড়ে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং, ধর্ষণ এবং খুন-খারাবি ইত্যাদিসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এদের বিবেকবর্জিত অত্যাচার, অযাচিত, মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতনে সমাজ বিষিয়ে উঠেছে। মানুষ অস্বস্তিকর অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে কোনো ধরনের সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্কই বেশি। তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়, মুখ বুজে সহ্য করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো, কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের গ্যাংয়ের দলে ভিড়িয়ে ফেলে। এ ছাড়া এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি কথা কাটাকাটি ও বচসা তো সর্বদা লেগেই আছে।
প্রশাসনের সর্বস্তরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং সচেতনতা বিশেষ করে ডিবি প্রধান হারুন সাহেবের এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও প্রশংসনীয় উদ্যোগের ফলে অনেকটা কমেছে এদের উশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড।
এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে তরুণদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও প্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকায় হিরোইজম বা সব কাজে অযথা বাহাদুরি, কাঁচা টাকা-পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিকচর্চার নামে সস্তা ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত এসব গ্যাং এবং তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে ডিজে নৃত্য, নদীপথে ট্রলারযোগে লাউড স্পিকার বাজিয়ে কিশোর-কিশোরীর উদ্যাম নাচশৈলী প্রদর্শন, টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে এবং নিজেকে গ্যাং স্টার ভেবে যা খুশি তাই করছে।
ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। উঠতি বয়সের, স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ওই দিকেই ঝুঁকছে। ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্তে জমা হচ্ছে নিকষকালো অন্ধকার। যারা এই জাতিকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে তারা যদি এই আগ্রাসী কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির চর্চা করে বেড়ে ওঠে তবে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। সুতরাং আজকের কিশোর গ্যাং কালচার দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহুরে জীবনের পাড়ায় পাড়ায় কিশোর-তরুণরা প্রথমে ছোট ছোট গ্রুপ করে ‘স্টার বন্ড’, ‘সাইজ কইরা দে’, ‘আমিই বস’ ইত্যাদি উদ্ভট অথচ রোমাঞ্চকর গ্রুপের নামে আড্ডাবাজি শুরু করে। ধীরে ধীরে শুরু হয় ছোট ছোট দলগত অপরাধকর্ম ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার বা দলগত সেরা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। অন্য দল বা অন্য এলাকার কিশোরদের ওপর প্রভাবশালী হয়ে ওঠার এক রোমাঞ্চকর স্বাদ তারা পেয়ে যায় কাউকে মারধর করে বা অপমান করে।
ভিকটিমরাও তখন প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে ঘটে যায় খুনের ঘটনা। জড়িত হয়ে পড়ে স্থানীয় নেতারাও। তারা ‘বড় ভাই’ হিসেবে আগলে রাখেন গ্যাংগুলোকে। বিনিময়ে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন এসব গ্যাংকে। গ্যাংয়ের সদস্যরাও ‘বড় ভাই’দের শেল্টারে থেকে নির্বিঘ্নে করে যায় নানা অপরাধ। ‘বড় ভাই’য়েরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্পর্শ থেকে আগলে রাখে গ্যাংয়ের সদস্যদের। এভাবে একটি কিশোর গ্যাং জন্ম নিয়ে দাপটের সঙ্গে এলাকায় বিস্তার করে ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’। এদের একটা অংশ বিকট শব্দে হর্ন (মোটরসাইকেল) বাজিয়ে স্টান্টবাজি করার নামে জনমনে আতঙ্ক ও পরিবেশের বিরূপ প্রভাব ফেলে নিজেদের মধ্যে আনন্দ উল্লাস ভাগ করে নিয়ে পরিবারের অপরাপর সদস্যকে অপমানিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
সমাজ চিন্তকরা মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। কালের আবর্তনে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় দৃশ্যমান। এক সময় আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সমাজে ‘মুরব্বি’ সংস্কৃতির চর্চা ছিল। পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। দূর থেকেই সালাম দিত, হাতে সিগারেট থাকলে ফেলে দিত। অন্যায় করতে দেখলে বড়রাও ছোটদের শাসন করত। ছোটরা বেয়াদবি করলে বড়রা এগিয়ে এসে বিচার-সালিশ বসাত। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়ছে। মুরব্বিরা ভীত, কিশোর-তরুণরা বেপরোয়া। সামাজিক সেই বন্ধন ও শৃঙ্খলা খসে পড়েছে। বাবা-মায়েরা পেশা ও ব্যবসায় টাকা রোজগারে ব্যস্ত। সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি দেখার সময় তাদের নেই? তা ছাড়া ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং পরিবারে ভাঙনের কারণে সন্তানরা সহজেই বিপথগামী হয়ে পড়ছে। একশ্রেণির নারীবাদীর উসকানিতে বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মীয় অনুশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনেকেই সামাজিক শৃঙ্খলা ও বন্ধনকে পদদলিত করে ফেলছে। ফলে ঘরে ঘরে আজ অশান্তির আগুন জ্বলছে। বস্তি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব ঘরের ছেলেমেয়েরাই এভাবে বিপথগামী হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। এদের প্রতিরোধের জন্য পরিবারের দায়িত্ব অনেক। সমাজেরও কিছু দায় রয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খেলার মাঠ, পুকুর, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা বা পুকুর-নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করার সুযোগ নিঃশেষ হয়ে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে গিয়েই গ্যাং সৃষ্টি করেছে। আগে অঞ্চলভিত্তিক, পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো, যাতে সবার মধ্যে সৌহার্দ্যর বন্ধন অটুট থাকে এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হতো। সেই সুযোগ হাল আমলে একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। আগে যেখানে সুস্থ বিনোদন ও সাংস্কৃতিকচর্চা হতো এখন সেখানে অপসংস্কৃতি জায়গা দখল করে নিয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির নামে আমরা নগ্নতা আর বেহায়াপনাকে আধুনিকতা হিসেবে সামনে নিয়ে আসছি এর দরুন কিশোর-তরুণরা অশ্লীলতাকে আর অপরাধ হিসেবে দেখছে না। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এই কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে কম দায়ী নয়। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরদের যেকোনো মূল্যে ‘জিপিএ-৫’ পাওয়ার দিকে পরিচালিত করে। তাত্ত্বিক এই শিক্ষাব্যবস্থায় না আছে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার দিকনির্দেশনা, না আছে কোনো মূল্যবোধের আদর্শে নিজেকে তৈরি করার বাস্তবমুখী গাইডলাইন। ফলে যারা মেধাবী তারা শুধু টাকা উপার্জনের রোবোটিক যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে আর বাকিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে।
শিশু-কিশোরদের পথভ্রষ্ট হওয়ার বড় একটি কারণ হলো, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। এক সময় প্রতিটি এলাকায় মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনদের একটি বিশেষ অবস্থান ছিল। তাদের ছোট-বড় সবাই মানত। শিশু-কিশোররা তাদের কথা অবশ্য পালনীয় মনে করত। তারাও এলাকার কিশোর-তরুণদের স্নেহ-আদর এবং শাসন করতেন। সমাজে সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির অবনতি ঘটেছে। একটি মহল প্রমাণ করতে মুখিয়ে থাকে, দেশ ও জাতির সব অনিষ্টের মূলেই ধর্ম এবং ‘হুজুর’রা। একশ্রেণির মিডিয়া অত্যন্ত সুকৌশলে এসব অপপ্রচারণাও চালিয়ে থাকে। ফলে সমাজের শিক্ষিতদের একটি অংশ মনে করে, নিখুঁতভাবে ধর্ম পালন করা গোঁড়ামি বা উগ্রবাদ চর্চার নামান্তর। বুঝে বা না বুঝে তারা ইসলাম ধর্মকে এবং এর আলেম-ওলামাকে অবজ্ঞা করে থাকেন। এর ফলে
আজ কিশোর-তরুণ-যুবকরা ধর্মীয় মূল্যবোধের শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে বেপরোয়া জীবনযাপন করতেই গর্ববোধ করতে চাচ্ছে। তা ছাড়া বেশ কিছু দিন ধরে কিছু আলেম-ওলামার ইসলামের ঐতিহ্যবিরোধী অতিমাত্রায় রাজনৈতিক বা মারমুখী অবস্থানের কারণে তারা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং সাধারণভাবে ইসলামিস্টদের সম্মানের হানি ঘটেছে। ফলে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী ওয়াজ মাহফিলে তরুণ-যুবারা মঞ্চে উঠে জনসমক্ষে মাহফিল ভণ্ডুল এবং আলেম-ওলামাদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করার সাহস পাচ্ছে। এসব কারণে সমাজের ওপর ধর্মীয় গুরুদের যে ঐতিহ্যগত সুশৃঙ্খল প্রভাব ছিল তা ঢিলে হয়ে পড়েছে। এর ভুল বার্তা যাচ্ছে কিশোর-তরুণদের কাছে। ঘরে-বাইরে কারও আদেশ-উপদেশে তারা কর্ণপাত না করে বরং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির চর্চার পেছনে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে কারণ সেটি হলো- রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর মতে, প্রধানত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘কিশোরদের রাজনীতিতে ঢোকানো হচ্ছে। একটা এলাকায় যে রাজনৈতিক কোন্দলগুলো রয়েছে, সে কোন্দলগুলোকে ধরে রাখা, প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই সরকারের উন্নতিতে বাধাদানকারী একটি চক্র ও রাজনীতিবিদেরই একটি গ্রুপ মনে করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিশোরদের দিয়ে গ্রুপ তৈরি করলে কম খরচে গ্রুপটিকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়, জানা যায়, বিরোধী দল এবং এর ছাত্র ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতা এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের সাবেক ও কতিপয় কাউন্সিলররা মহানগরের নিজ নিজ এলাকার গোপনে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, এভাবে যেসব ‘বড় ভাইরা’ গ্যাং পরিচালনা করেন তারাই হয়ে ওঠেন কিশোরদের রোল মডেল। ফলে এই কিশোর-তরুণরা ওই সমস্ত ‘বড় ভাইদের’ মতো করে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। অন্যদিকে, বিদ্যমান আইনও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে। ১৯২২ সালের বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট থেকে ১৯৭৪ সালের শিশুআইন এবং সর্বশেষ প্রণীত শিশুআইন ২০১৩ করা হয়েছে শিশুদের জন্য; কিন্তু এই আইনের ফাঁকফোকরে কিশোররা ‘শিশু’তে সংজ্ঞায়িত হওয়ায় কিশোর গ্যাং দমনে এটি একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই নীতি-নির্ধারকরা এই আইনটি নিয়ে নতুন করে দ্রুত ভাবতে হবে। কিশোর অপরাধ নিয়ে এখানে ১৯৬০ সালে পুলিশের জন্য প্রথম গবেষণা হয়েছিল। তারপর এর কোনো ফসল ঘরে উঠেছে কি না তা বোধগম্য। এ যাবৎ মোট বেশ কিছু গবেষণার সন্ধান করে পাওয়া যায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দরকার আলাদা কিশোর অপরাধ আইন। আর কিশোরদের যেকোনো মূল্যেই রাজনীতির বলয়ের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে এসব কিশোর গ্যাংয়ের অভ্যন্তরীণ শক্তি লোপ পেয়ে এই অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা অবশ্যই ফিরে আসবে। আর দেশ এবং জাতি একটি ভয়াবহ আসন্ন মহাদুর্যোগ থেকে নিস্তার পাবে ইনশাআল্লাহ।