কক্সবাজারে ঘুষে চলছে শতাধিক অবৈধ ইটভাটা

কামরুল হাসান প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারী , ২০২৫ ১৬:৪৩ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারী , ২০২৫ ১৬:৪৩ পিএম
কক্সবাজারে ঘুষে চলছে শতাধিক অবৈধ ইটভাটা

কক্সবাজারের রামুসহ বিভিন্ন উপজেলায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ইটভাটা আর ইটভাটা। এসব ইটভাটার অধিকাংশই অবৈধ। অধিকাংশের নেই লাইসেন্স। নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফসলের মাঠ উজাড় কিংবা লোকালয় ঘেঁষে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। পাহাড়ের মাটি কিংবা উর্বর জমির টপ সয়েল কেটে অবাধে এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে ইট। প্রশাসন ও পরিবেশ দপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা। আবার যেগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে, সেগুলোয় মানা হয় না কোনো পরিবেশ আইন ও নির্দেশনা। রামুতে পরিবেশদূষণে এসব ইটভাটার ভূমিকাই বড়।
জেলা প্রশাসন, বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ১০৮টি। এর মধ্যে ৩৩টি ইটভাটা নির্মিত হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে। অপর ৫৪টি ইটভাটা বিভিন্ন গ্রামে তৈরি হলেও এসবের বিপরীতেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই।
অভিযোগ আছে, অবৈধ এসব ইটভাটা বছরের পর বছর চলছে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। জেলায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে রামু উপজেলায়। এসব ইটভাটার প্রায় সবই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ও লোকালয়ে।
রামু উপজেলার ফঁতেখারখুল ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া গ্রামের সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া কয়েকটি ইটভাটা তৈরি করা হয়েছে। যারমধ্যে ‘হাম ব্রিকস’ নামের একটি অবৈধ ইটভাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হচ্ছে।
লম্বরীপাড়া গ্রামের কৃষক রমজান, নুরুল ইসলাম, কবিরসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, ওই ইটভাটাটি চালু হওয়ার পর কোন ফসলেই ভালো ফলন হচ্ছে না। রমজান তার টমেটো ক্ষেত দেখিয়ে বলেন, ‘একবার টমেটো না তুলতেই গাছগুলো মরে যাওয়ার মতো হয়েছে। আগে এখানে কয়েক মাস ধরে টমেটো ফলন পাওয়া যেত।’ তাদের দাবি, ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় ধুলোবালিতে ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ইটভাটার নিজস্ব মাটিভর্তি ডাম্পার চলাচলের কারণে রাস্তাগুলো ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। লোকালয়ে স্থাপন করা ইটভাটা পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে বলে দাবি করে এক স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘লম্বরীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ‘হাম ব্রিকস’ নামের ভাটা স্থাপন হয়েছে। এলাকাবাসী অভিযোগ দিলেও বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘ওই ভাটার মালিক হোসেন খুব বেপরোয়া। কেউ প্রতিবাদ করলে হুংকার দিয়ে বলেন, ডিসিসহ পরিবেশ অধিদপ্তরকে টাকা দিয়ে ভাটা করতেছি, কিছু বলার থাকলে তাদের গিয়ে বলুন। এই ইটভাটা বন্ধের জন্য নানা মহলের পক্ষ থেকেও জেলা প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হলেও তারা আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না।’ ওই ভাটাটির পরিবেশের ছাড়পত্রসহ বৈধ কোনো কাগজ নেই বলেও দাবি করেন তিনি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড় কাটার মাটি ও ফসলি জমির টপ সয়েল দিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চার-পাঁচ বছর ধরে ভাটায় অবৈধভাবে ইট তৈরি করা হলেও উচ্ছেদ হচ্ছে না। ওই ইটভাটা মালিক মোহাম্মদ হোসেন দাম্ভিকতার সাথে বলেন, ‘আমার ভাটার কাগজপত্র আপনাদের দেখাতে হবে কেন? হেড়াম থাকলে প্রশাসনকে গিয়ে বলুন।’ আইন অনুযায়ী, কৃষিজমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার এবং ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়কের অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। আইন অমান্য করলে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড, অন্যূন ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন অমান্য করেই সারা জেলার মতো রামুতে খেয়ালখুশিমতো চলছে ইটভাটা বাণিজ্য। এ কারণে বেশির ভাগের কোনো ধরনের দণ্ডের মুখোমুখি হতে হয় না। আবার কেউ যদি দণ্ডিত হন, পরে কৌশলে আবারও নতুন করে একই স্থানে গড়ে তোলেন ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসকদের অনুমোদন ছাড়াই সারা রামুতে সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে প্রায় অবৈধ ইটভাটা। ইটভাটার পাশের ঘরবাড়িতে বসবাসকারীদের অভিযোগ, বছরের পর বছর এসব অবৈধ ইটভাটা পরিচালিত হলেও বন্ধ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উলটো প্রশাসনকে ঘুষ দিয়েই ইটভাটার মালিকরা এসব ভাটা পরিচালনা করছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে জানা গেছে। যদিওবা কক্সবাজার জেলায় বন্ধ থাকা কয়েকটি ইটভাটায় লোক দেখানো অভিযান হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করে কিভাবে এত দিন এসব ইটভাটা গড়ে তোলার পর পরিচালিত হচ্ছিল সে প্রশ্ন সবার। বিষয়টি নিয়ে অন্তত ১০ জন ইটভাটা মালিকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। প্রত্যেকে নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব ইটভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতি বছর শুধুমাত্র পরিবেশ অধিদপ্তরকে ৩/৪ লাখ টাকা দিতে হয় বলে দাবি করেছে একাধিক ভাটা মালিক।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo