আজ ১লা জুলাই, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও জাতীয় চেতনার বাতিঘর, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ১০৪তম জন্মদিন উদযাপন করছে। এই দিনটি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, সংগ্রাম ও অগ্রগতির এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক। দীর্ঘ ১০৪ বছরের পথচলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে আলোর দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের সাথে এর সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িত, যা এটিকে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের এক গৌরবময় ইতিহাসের ধারক করে তুলেছে । বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ,১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন,২৪ এর গণ-আন্দোলন সব ক্ষেত্রে-ই অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। বঙ্গভঙ্গ, এর রদ এবং পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত অনগ্রসরতাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করে।১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন 'পূর্ব বাংলা ও আসাম' প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ায় মুসলিম নেতারা শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এমন আশায় উজ্জীবিত ছিলেন । তবে, এই বিভাজন গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। ফলস্বরূপ, ১৯১১ সালের ১লা নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় ।বঙ্গভঙ্গ রদ পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজে গভীর ক্ষোভ ও বঞ্চনার সৃষ্টি করে । তারা মনে করে, এই সিদ্ধান্ত তাদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে, যা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল । এই রদকে কেবল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি পূর্ব বাংলার মুসলিমদের মধ্যে এক গভীর বঞ্চনাবোধ তৈরি করে, যা তাদের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়ার ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে, যা নিছক ক্ষতিপূরণ ছিল না, বরং মুসলিম সমাজের আত্মোন্নয়নের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল। এটি ব্রিটিশ "ভাগ কর,শাসন কর" নীতির একটি পরোক্ষ ফল হলেও, পূর্ব বাংলার মুসলিমদের জন্য এটি ছিল আত্ম-উন্নয়নের একটি সুযোগ।ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের দাবি বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এবং পূর্ব বাংলার মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে । ১৯১২ সালের ২১শে জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে এলে ঢাকার মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করার অনুরোধ জানান । লর্ড হার্ডিঞ্জ এই সুপারিশে সম্মত হন এবং এটিকে মুসলিমদের প্রকৃত মুক্তির পথ হিসেবে দেখেন।১৯১২ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে 'নাথান কমিটি' গঠন করা হয় । এই কমিটির ২৫টি সাব-কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারত সরকার প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা স্থির করে । পরবর্তীতে, ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (স্যাডলার কমিশন) ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে । যদিও তারা নাথান কমিটির 'সরকারি বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়' করার প্রস্তাব সমর্থন করেনি, বরং আবাসিক ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দেয় । স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি. জে. হার্টগ, যিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তিনি এই উদ্যোগের অগ্রদূত ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নিজের এস্টেট থেকে ৬০০ একর জমি দান করেন । তাঁর মৃত্যুর পর (১৯১৫ সালে) নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই উদ্যোগকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান । তাঁরা ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে দাবি পেশ ও চাপ সৃষ্টি করে এর বাস্তবায়নে অসাধারণ দৃঢ়তার পরিচয় দেন । নবাব সলিমুল্লাহ 'ইসলামিক স্টাডিজ' বিষয়ের সাব-কমিটির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (স্যাডলার কমিশন) এর সুপারিশসমূহ কিছু রদবদল সহ ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক 'দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-১৯২০' পাশ হয়। ফলস্বরূপ, ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান, আইন), ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক এবং ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে । প্রাথমিকভাবে ঢাকা হল(ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল এবং মুসলিম হল(সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়।গৌরবময় অতীত, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম জন্মদিন কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত স্বপ্ন, সংগ্রাম ও অর্গতির প্রতিচ্ছবি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিদ্যাপীঠ জ্ঞানচর্চার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিটি বাঁকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অসংখ্য প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে, যারা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে অবদান রেখেছেন।আশা করি অতীতের গৌরবময় অধ্যায়কে পাথেয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক মানদণ্ডে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে এবং আগামী দিনেও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে টিকিয়ে রাখবে।