কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকের নাম বললেই চলে আসে বিখ্যাত শুঁটকি মহালের কথা। কিন্তু এটি শুধু শুঁটকির জন্য নয়, শুঁটকির গুড়ার জন্যও বিখ্যাত। যা দেশের সিংহভাগ মাছ, হাসমুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির চাহিদা পূরণ করে আসছে। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল শুঁটকি গুড়ার মহাল। প্রতিবছর এখান থেকে বিপুল পরিমাণ শুঁটকির গুড়া উৎপাদন হয়। যা দেশের মাছ ও গবাদি পশুর খাদ্য তৈরির সিংহভাগ জোগান দেয়। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে খাবার অনুপযোগী যেসকল মাছ ধরা পড়ে এবং কূলে ফিরতে ফিরতে যেসব ছোট মাছ পঁচে নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো শুঁটকির গুড়া ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। এসব পঁচা মাছ, শুঁটকি তৈরির পর মাছের নাড়িভুঁড়িসহ উচ্ছিষ্ট তপ্ত রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। এরপর তাতে লবণ,ময়দা, খইল, ভুসি, ঝিনুক মিশিয়ে ক্রাশার মেশিনে চূর্ণ করা হয়। দাম ধরা হয় কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা। পরে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকির গুড়া তৈরি করে উৎপাদনকারীরা। পরে এই মিহি হয়ে যাওয়া গুঁড়া বিক্রির জন্য বস্তাভর্তি করেন শ্রমিকরা। আগস্ট মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস এসব গুঁড়া তৈরির মৌসুম। কর্মব্যস্ত শ্রমিকরা জানান, এটি শুঁটকিগুড়া নামে পরিচিত। পোল্ট্রি ও পশুর খাবারে এই শুটকি গুঁড়া ব্যবহার করা হয়, নাজিরারটেক এলাকায় এই কাজের সাথে ২ থেকে ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করে। যাদের দৈনিক মজুরি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। তার মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছে অনেক। শুঁটকি গুড়া তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিক নাজিম উদ্দিন বলেন, 'আমি এই কাজে ১০ বছর যাবত কাজ করছি। এ পেশায় আমাদের সংসার চলে। এই কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ এই কাজ করতে গিয়ে কখনো শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করিনি। মালিক কর্তৃপক্ষ বেতন নিয়ে বৈষম্য করে না। নাজিরারটেক শুঁটকি গুড়া ব্যবসায়ী ওসমান সরোয়ার বলেন, নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লীতে বর্তমানে ২০ টি ক্রাশার মেশিন আছে। এই মেশিনের সাহায্যে শুঁটকির গুঁড়া তৈরি করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত মাছের খাদ্য তৈরির কোম্পানি গুলো এই শুঁটকির গুঁড়া নিয়ে যায়। অনেক সময় বেপারিরা গুঁড়া করা ছাড়াও আস্ত শুঁটকি নিয়ে যায়। রুবেল নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এসব নষ্ট হয়ে যাওয়া মাছ যদি শুঁটকির গুড়া হিসেবে তৈরি করার ব্যবস্থা না থাকতো, তাহলে সেগুলো ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকতো না। কিন্তু শুঁটকির গুড়া উৎপাদন হওয়াতে এখান থেকেও বাড়তি আয় হয় ট্রলার মালিকদের। সায়মন ইসলাম নামের আরেক শুঁটকি গুড়া ব্যবসায়ী বলেন,পঁচা ও গলে যাওয়া মাছ কেনার পর খোলা জায়গায় চট বিছিয়ে সেগুলো শুকানো হয়। টানা ৩ থেকে ৪ দিন শুকানোর পর শুঁটকির গুড়া হিসেবে তৈরি হয়। পরে বস্তা ভর্তি করে ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, রাজশাহী,বগুড়া সহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্রির জন্য নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। আবার দেশের বিভিন্নস্থানের ফিড মিল মালিকেরাও সরাসরি শুঁটকির গুড়ার জন্য নাজিরারটেকে এসে থাকেন। নাজিরারটেকের ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি শুঁটকির গুড়া বিক্রি করে ৪০ থেকে ১৭০ টাকায়। নাজিরারটেক শুঁটকি গুড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আঃ ক ম নিয়ামত উল্লাহ বলেন, কক্সবাজার থেকেই এই খাতে গতবছরে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি গুড়া সরবরাহ করা হয়। যার আনুমানিক বাজার দর ৮' শ কোটি টাকার মম । সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর যদি উদ্যোগী হয়ে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করে তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্য দেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা সরকার পাবে পর্যাপ্ত রাজস্ব। যদি এখানে এই শুঁটকি গুড়া তৈরি করা না হতো তাহলে এগুলো বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এক্ষেত্রে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। গত মৌসুমে ১৭০টি মহালে অন্তত ৮'শ কোটি টাকার শুঁটকিগুঁড়া উৎপাদিত হয়েছিল। চলতি মৌসুমেও উৎপাদন চলছে ১৭০টি মহালে। তিনি আরো বলেন, সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করতে প্রস্তুত। কক্সবাজার সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুজয় পাল বলেন, 'মাছের খাদ্য, পোল্ট্রি ও পশু খাদ্য তৈরির সময় প্রোটিনের উৎস হিসেবে এই শুঁটকির গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। যারা শুঁটকির গুঁড়া তৈরির সাথে সম্পৃক্ত আছেন তাদের এই বিষয়ে সচেতনতামূলক ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ বদরুজ্জামান বলেন, 'অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মাছ উৎপাদনে পৃথিবীতে তৃতীয় অবস্থানে আমরা চলে এসেছি। আরো ভালো অবস্থানে যেতে ইতিমধ্যে সরকার নানান পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ।সেই ক্ষেত্রে আমাদের এ্যকোয়া কালচার এর পাশাপাশি মেরীন কালচারটাকে এক্সপ্যান্ড করতে হবে। এ্যকোয়া কালচার আর মেরীন কালচার টাকে এক্সপ্যান্ড করতে গেলে চাষের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমানে মাছের খাবারের দরকার হবে। সেই মাছের খাবারের অন্যতম উপাদান হচ্ছে প্রোটিন, যেটা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় ফিসমিল বা মাছের গুঁড়াতে। এ ধরনের ফিস মিল আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে একটা বড় চাহিদা আছে। আমরা এই চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে নিজেদের উৎস থেকে সংগ্রহের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানী করে থাকি। তিনি আরো বলেন, যে মাছগুলো সাধারণত মানুষ খায় না সেগুলো কে শুকিয়ে, গুড়ো করে কক্সবাজারের নাজিরারটেকের ব্যবসায়ীরা মাছের ফ্যাক্টরিতে সরবরাহ করছে। সেখানে এসব মাছের গুঁড়া খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই খাতের একটা অমিত সম্ভাবনা আছে। এই শিল্পটাকে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে পেট্রোনাইজ করব, আমরা নিজেদের স্বার্থে। শুটকি মাছ বা শুটকি মাছ সম্পর্কিত যে পণ্যগুলো আছে , এখানো পর্যাপ্ত তা কোন আইনের আওতায় আনা হয়নি। ফলে শুটকি উৎপাদনকারী কিংবা এর সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিবন্ধন এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে মৎস্য পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০২০ পাস হয়েছে। বিধিমালাটা খসড়া পর্যায় আছে। বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর শুটকি মাছ ও শুটকির গুড়া ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত আছে এমন স্টেকহোল্ডারদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে এসে এই পন্যের গুণগতমান যাতে ঠিক থাকে সেভাবে আমাদের মৎস্য অধিদপ্তর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শুটকি মাছ বা শুটকি গুড়া ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের মধ্য থেকে ৮০০ জনকে বিভিন্নভাবে ট্রেনিং এর আওতায় আনা হয়েছে। কক্সবাজার চেম্বার অফ কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, 'এই খাত থেকে যেহেতু বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যবসা হচ্ছে। তাই এই খাতটিকে মৎস্য অধিদপ্তরের একটি মনিটরিং সেলের আওতায় এনে এই খাত কে উন্নত করা সময়ের দাবী। পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদনের ফলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি সুযোগ রয়েছে। সরকারের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগানো। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সবসময়ই ব্যবসায়ীদের পাশে থাকে। তিনি আরো বলেন,আমরাও তদারকি করে দেখব কোন কোন দেশে পণ্যটি রপ্তানি করা যায়। প্রয়োজনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে বৈঠক করে রপ্তানির বিষয়ে উদ্যোগ নিতে কাজ করব।পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি এই শুটকি গুড়া বা ফিসমিল ব্যবসায়ীরা যদি বিদেশে রপ্তানি করতে পারে তাহলে এই শহরের জীবন জীবিকা আরো উন্নত হবে দূর হবে বেকারত্ব সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান কক্সবাজার চেম্বার্স অফ কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে এই খাতে বিনিয়োগকারীদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।