মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কেরামত নগরে অবস্থিত ‘আলহাজ্ব কেরামত আলী জামে মসজিদ’ এক অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। মোগল স্থাপত্যরীতির অনুসরণে ১৯৬৭ সালে নির্মিত এই তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি কেবল ধর্মীয় উপাসনার স্থানই নয়, বরং এটি কমলগঞ্জের স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক গৌরবময় প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত।জানাযায়, মসজিদটির নির্মাতা ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও দানবীর আলহাজ্ব মো. কেরামত আলী। তিনি কেবল একজন ধর্মপ্রাণ মানুষই ছিলেন না, ছিলেন সমাজ উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব। তাঁর উদ্যোগেই মোগল আমলের শৈলী ও স্থাপত্য নকশা অনুসরণ করে মসজিদটি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে মসজিদের নামকরণ করা হয় ‘আলহাজ্ব কেরামত আলী জামে মসজিদ’।মসজিদটির মূল ভবনের নকশা ও নির্মাণশৈলীতে মোগল আমলের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়েছে। প্রধান ভবনের ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ—মধ্যখানে একটি বৃহৎ গম্বুজ এবং তার দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজের কারুকাজ নিখুঁতভাবে তৈরি, যেখানে ইরানি ও উপমহাদেশীয় শৈলীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। গম্বুজ ও দেয়ালে ব্যবহৃত হয়েছে ইরান থেকে আমদানি করা মূল্যবান পাথর। গম্বুজগুলোর অলঙ্করণে ইসলামী জ্যামিতিক নকশার নিখুঁত ছাপ রয়েছে।চারকোণায় স্থাপিত সুউচ্চ মিনারগুলো এই মসজিদের সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। মিনারগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে টেরাকোটার কাজ ও মার্বেলের নিখুঁত নকশা, যা স্থাপত্য রসিকদের জন্য এক দর্শনীয় উপাদান।মসজিদের ভেতরের অংশে রয়েছে প্রশস্ত নামাজঘর, ঝকঝকে মোজাইক টাইলস ও মার্বেল পাথরের ব্যবহার। ভেতরে প্যান্ডেল আকৃতির ছাঁদ এবং দেয়ালে সুরা লেখা সজ্জা মসজিদটির আভিজাত্য ও পবিত্রতা ফুটিয়ে তুলেছে। অত্যন্ত শান্তিময় ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সাজানো এই মসজিদটি মুসল্লিদের জন্য একটি আত্মিক প্রশান্তির কেন্দ্র।মসজিদের সঙ্গে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, সুপরিকল্পিত ঘাট, আধুনিক অজুখানা এবং ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য পৃথক আবাসন কোয়ার্টার। নামাজ পড়ার পর মুসল্লিরা পুকুরপাড়ে বসে প্রশান্তির সময় কাটাতে পারেন। এসব সুযোগ-সুবিধা মসজিদটিকে করে তুলেছে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক স্থাপনা।প্রায় এক হাজার মুসল্লি একসাথে এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশেষত জুমার দিনে দূরদূরান্ত থেকে মুসল্লিরা এই মসজিদে এসে জমায়েত হন। ধর্মীয় উৎসব বা ঈদের জামাতে এই মসজিদ এলাকাটি ধর্মীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়।স্থানীয় প্রবীণ মুসল্লি মো. আব্দুল মন্মান (৭০) বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই এই মসজিদে নামাজ পড়ি। এখানকার পরিপাটি পরিবেশ আর মসজিদের সৌন্দর্য আমাদের গর্বিত করে। সরকার যদি এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংরক্ষণে সহায়তা করে, তাহলে এটি আরও সুন্দরভাবে টিকে থাকবে।”তরুণ মুসল্লি মো. সোলাইমান উদ্দিন (৩৫) বলেন, “আমরা যারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসি, তারা গর্ব অনুভব করি এমন একটি স্থাপনার অংশ হতে পেরে। তবে জুমার দিনে জায়গা সংকট হয়, এজন্য মসজিদের সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি।”প্রসঙ্গত: কেরামত আলী জামে মসজিদ এখন শুধু কেরামত নগর নয়, বরং পুরো মৌলভীবাজার জেলার জন্য এক সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গর্বের স্থানে পরিণত হয়েছে। মসজিদটিকে ঘিরে একটি ইসলামিক দর্শনকেন্দ্র বা হেরিটেজ স্পট গড়ে তোলারও বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের সুনজর ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই স্থাপনাটি পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেও সমৃদ্ধ হতে পারে। এই মসজিদ নিঃসন্দেহে একাধারে ধর্ম, ইতিহাস, স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যের এক অনন্য সংমিশ্রণ। সময় এসেছে এই ধরণের স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উপহার দেওয়ার।