বীরগঞ্জের ১৫১ বছরের ঐতিহাসিক ঢেমঢেমিয়া কালি মেলা

মোঃ ফেরদৌস ওয়াহিদ সবুজ প্রকাশিত: ১১ নভেম্বর , ২০২৩ ১২:৪৭ আপডেট: ১১ নভেম্বর , ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম
বীরগঞ্জের ১৫১ বছরের ঐতিহাসিক ঢেমঢেমিয়া কালি মেলা
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ২নং পলাশবাড়ী ইউনিয়নের সোনাচালুনী ও চাপাপাড়া মৌজায় ১৫০ বছরের ঐতিহাসিক ঢেমঢেমিয়া কালিমেলা পরিপূর্ণভাবে জমে উঠেছে।

দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ২নং পলাশবাড়ী ইউনিয়নের সোনাচালুনী ও চাপাপাড়া মৌজায় ১৫০ বছরের ঐতিহাসিক ঢেমঢেমিয়া কালিমেলা পরিপূর্ণভাবে জমে উঠেছে। উত্তরবঙ্গের সনাতন ধর্মালম্বীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লাখ লাখ মানুষের বার্ষিক বিনোদনের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী মৌসুমী বিনোদনসহ গণমানুষের মিলনমেলা হিসেবে বীরগঞ্জ উপজেলার ঢেমঢেমিয়া কালির মেলা সর্বাধিক প্রশংসিত ও প্রসিদ্ধ এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উপজেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বৈরবাড়ী, চাপাপাড়া ও হিরামণি মৌজায় এ মেলার অবস্থান।

বাংলা ১২৮০ সাল থেকে ঢেমঢেমিয়া কালিমেলা পল্লী বিনোদনের ঠিকানা। প্রতি বছর কর্তিক মাসের আমাবশ্যায় সনাতন ধর্মালম্বীদের শ্যামা পূজায় এ মেলার আয়োজন করা হয়। সাতদিন যাবত পূজা অর্চনা হলেও মেলা চলে মাসব্যাপী। কালি মন্দিরটি তার নিজস্ব ১ একর জমিতে একটি উচ্চ অট্টালিকা। পাশেই মাত্র কয়েক গজ পশ্চিমে দরবেশ মিরাজুন মিয়ার মাজার শরীফ রয়েছে। এক কথায় মেলার সময় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল গোত্রের মানুষেরা এখানে এসে এ মেলা উপভোগ করে। বছরে একবার এলাকার মানুষ বিশাল এই আয়োজনকে প্রাণভরে উপভোগ করে আসছে। পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও, উত্তরে পঞ্চগড়, পূর্বে নীলফামারী ও দক্ষিণে দিনাজপুর। ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কয়েকটি জেলার মধ্যস্থল হওয়ায় কালিমেলা উদ্বোধনের আগে থেকেই মানুষের মাঝে সাজ সাজ রব পড়ে। সবার মুখে মুখে মেলার দিনক্ষণ গননা শুরু হয়। মেলার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ শ্যামা পূজার প্রথম রাতে লগ্নমতে কালি পাটে চড়া। কালি পাটে চড়া অর্থাৎ মহিষ কিংবা পাঠা বলি দান। নেঁচে গেয়ে বাদ্যের তালে তালে হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে উদ্বোধনী রাত্রিতে পূজারীরা আনন্দঘন পরিবেশে এ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়।

কালি পাটে উঠবে এ মর্মে অনেক আগে থেকেই সোরগোল চলতে থাকে। সে আলোকে আশাবাদী দর্শকেরা মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। মেলায় গ্রামের জনগণের মনের খোরাক অফুরন্ত বিনোদনের জন্য যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, সার্কাসসহ বিভিন্ন ইভেন্ট ও ডিজিটাল সময়ের ভ্যারাইটি, ম্যাজিক ‘শো’ সম্বলিত নানা উপকরণে ভরপুর থাকে। বছরে একটি মাস প্রত্যন্ত পল্লীর মানুষের বিনোদনের এক অপূর্ব আয়োজন ও প্রায় দেড় শত বছরের অতীত ইতিহাস হিসেবে দেশের উত্তরবঙ্গে ঢেমঢেমিয়া কালিমেলা কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। জানা গেছে, স্বর্গীয় সংশয় সরকার বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বৈরবাড়ী, চাপাপাড়া ও হিরামনি মৌজায় বাংলা ১২৮০ সনে কার্তিক মাসের আমাবশ্যায় দিবাগত রাতে তাদের ধর্মীয় রীতিতে লগ্ন মোতাবেক একটি পাঠা বলীর মাধ্যমে ঢেমঢেমিয়া কালিমেলার শুভ সূচনা করা হয়। সে সময় পূজারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শ্রীযুক্ত সংশয় সবকার এবং সভাপতি ছিলেন মেলা আয়োজনে জমিদাতা জোতদারগণের অন্যতম চাপাপাড়ার বাসিন্দা মরহুম দবির উদ্দিন শাহ্, স্বল্প পরিসরে প্রথমে শুরু করা হলেও দিনান্তর মেলার বিস্তৃতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মেলার নামানুসারে এখানে গণমানুষের সহায়তা ও আন্তরিকতায় একের পর এক স্থাপিত হয়, প্রাথমিক স্কুল. মাদ্রসা ও কালিমেলা উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান, ভুতুরে ধু ধু আবাদী কান্দর এলাকাটি পরিণত হয়েছে আলোকময় সভ্যতার এক অপূর্ব নিদর্শন।

শিক্ষাঞ্চল হিসেবেও অনেকটাই প্রশংসার দাবিদার এই এলাকাটি। কালি মাতার সম্মানে ভক্তরা শত শত আবার কেউ কেউ হাজার হাজার নগদ অর্থ, সোনা, রূপাসহ মূল্যবান অনুদান সেবায়েতকে মায়ের তথা কালি মন্দির অনুদান এবং উন্নয়নে দান, গুরু দক্ষিণা, প্রকাশ্য প্রণামী দিয়ে থাকেন। শ্যামা পূজার ২/৪ দিন আগে নির্মিত কালিকে ঢেমঢেমিয়া কালি মেলা মন্দির প্রাঙ্গণে পূজার উদ্দেশ্যে এলাকার হাজার হাজার সনাতন ধর্মালম্বী নারী-পুরুষেরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিয়ে আসেন। কালিমাতা এসে অবস্থান নেয় তার নিজস্ব অট্টালিকায়। হিন্দু ধর্ম মতে শ্যামা পূজা লাগাতার সাত দিন যাবত চলে, ঠিক লগ্নের সময় সেবায়েত পূজা আরম্ভ করেন ও আগন্তকদের ভোগ বিতরণ করা হয়। পূজারী তাদের পুঞ্জিকা অনুসরণ করেন।
 
শুক্রবার দিবাগত রাতে সরেজমিনে গেলে ঢেমঢমিয়া কালির মেলার চলতি বছর কমিটির সভাপতি পলাশবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তাক আহম্মেদ সিদ্দিকী মানিক জানান, আগামী ১২ নভেম্বর'২৩ মেলার শুভ উদ্বোধন করা হবে, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মেলাটির সমগ্র এরিয়ায় সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ইতোমধ্যে গরু, মহিষ, ঘোড়াসহ নানান পশু ক্রয় বিক্রয়ের অনেক ক্রেতা বিক্রেতার আগমন ঘটেছে এবং প্রশাসনিক কঠোর নিরাপত্তা রয়েছে। সভাপতি আরও জানান ১২ নভেম্বর'২৩ হতে আগামী ১৫ দিন পর্যন্ত সরকারীভাবে অনুমোদন পাওয়া গেছে, তিনি ঐতিহ্যবাহী কালি মেলার অতীতের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

এ সময়  উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ফজলে এলাহী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজ কুমার বিশ্বাস, বীরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মুজিবুর রহমান, মরিচা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আতাহারুল ইসলাম চৌধুরী হেলাল, সুজালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল ইসলাম মাষ্টার, মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবদুল গফ্ফার, সেবায়েত জগদিশ চন্দ্রসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যাক্তি বর্গ উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo