ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ১৭টি স্থানে বেড়িবাঁধ ধসে অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ফেনী সদর, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অন্তত ২০ হাজার মানুষ। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়েছে নদ-নদীর পানি, সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি।

ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা আলী আশরাফ নিজের চোখের সামনে ভেঙে যেতে দেখেছেন তার ঘর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন,
“দুপুর থেকে মুহুরী নদীর পানি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার দিকে গ্রামের পাশে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। মুহূর্তেই পানিতে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা, পানি ঢুকে পড়ে ঘরে। চোখের পলকে আমার ঘরটি নদীতে ভেঙে পড়ল। কোনোমতে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়েছি।”

আশরাফ জানান, গতকাল মঙ্গলবার রাতে তার ও ছোট ভাই আলী রাজের ঘর মুহুরী নদীতে ধসে পড়ে। বর্তমানে তারা গ্রামের এক ভাগনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই আজ বুধবার সকালে তার সঙ্গে কথা হয়।

আজ বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ফুলগাজী উপজেলার সাতটি অংশে এবং পরশুরাম উপজেলার ১০টি অংশে নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে মুহুরী নদীর ছয়টি, কহুয়া নদীর তিনটি এবং সিলোনিয়া নদীর একটি অংশে ভাঙন দেখা গেছে।

ফুলগাজীর ইউএনও ফারিয়া ইসলাম জানান, বাঁধ ভেঙে অন্তত ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন এবং তাদের সরকারিভাবে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান বলেন,
“আজ সকাল পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলার ১৫টি গ্রাম পানিবন্দী। নদ-নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ভারতের সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি গত দুই দিনে বিপজ্জনক হারে বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে নদীগুলোর অন্তত ১৫টি অংশে বাঁধ ধসে গেছে।

পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন,
“টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। গত দুই দিনে বাঁধ ভেঙে বহু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।”

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার জানান,
“বৃষ্টি বন্ধ হলে এবং পানি কমলে ক্ষতিগ্রস্ত অংশে মেরামত শুরু হবে। নতুন করে ভাঙন যেন না ঘটে, সে জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠে কাজ করছেন।”

ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন,
“আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ছিল ৪৪১ মিলিমিটার—চলতি বর্ষা মৌসুমের সর্বোচ্চ। আরও দুই দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।”

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, বন্যা মোকাবিলায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, আজ সকাল পর্যন্ত ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ফুলগাজীতে ৯৯টি, পরশুরামে ৩২টি এবং ফেনী সদর উপজেলায় ২২টি। ১১৫টি পরিবারের ৩৪৭ জন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। এসব কার্যক্রমে ২ হাজার ৫৪৭ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন বলেন,
“বন্যা মোকাবিলায় জেলার সব উপজেলায় ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার সমন্বয়ে কার্যক্রম চলছে। ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ।”

শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা আরিফুর রহমান জানান,
“মুহুরী নদীর বাঁধ ২০২২ সাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পাউবো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই গতকাল অন্তত ৪০ ফুট বাঁধ ধসে দক্ষিণ শ্রীপুর, বাসুরা, করইয়া, নিলক্ষী ও গোসাইপুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।”

মুহুরী নদীর পানি আজ সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর ছয় উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রাণ হারান ২৯ জন, পানিবন্দী ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকার।

পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসন মাঠে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত থাকলেও দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বাঁধ মেরামত ও স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।