সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীরা এখন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, ডাক্তার ও ওষুধের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নিতে গিয়ে তারা আরও কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছেন। পদে পদে স্বীকার করছেন ভোগান্তির।খালিশা চাপানি ইউনিয়নের বাইশপুকুর গ্রামের দিনমজুর আব্দুল খলিল বলেন, “আমি গরিব মানুষ, ভ্যানে চালিয়ে যা আয় করি, তা দিয়েই সংসারের সাত-আটজনের খাওয়া জোটে। হঠাৎ আমার বাবার পেটে তীব্র ব্যথা হলে তাকে ডিমলা হাসপাতালে ভর্তি করি। ডাক্তার দেখেছেন, কিন্তু কোনো ওষুধ দেননি। সবকিছু বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে। হাসপাতালের খাবারও ভালো নয়। সরকারি হাসপাতালে যদি চিকিৎসা ও ওষুধ না পাই, তাহলে আমরা কোথায় যাব?”টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখরিবাড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, “আমার স্ত্রী প্রসব ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ডেলিভারির সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ থেকে শুরু করে গ্লাভস পর্যন্ত সবকিছু বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। এমনকি স্যালাইনও হাসপাতালে মজুদ ছিল না।”
রোগী লতিফা বেগমের ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, “ডাক্তারের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক সময় নার্স বা ওয়ার্ড বয়ই পরামর্শ দেয়। আমরা যদি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারতাম, তাহলে এখানে আসার প্রয়োজনই হতো না।”
বালাপাড়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারহাট এলাকার রমিজা খাতুনের অভিযোগ, “আমার ছেলে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। ডাক্তার মাত্র একবার দেখে গেছে, পরে আর দেখা যায়নি। রাতে জরুরি ওষুধের জন্য বাজারে যেতে হয়েছে।”
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে রোগীদের ভোগান্তি প্রকট। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং জনবল ও তদারকির ঘাটতির কারণে হাসপাতালটি সেবা দেওয়ার পরিবর্তে বিড়ম্বনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ওষুধ, ডাক্তার ও কর্মচারীর সংকট এবং জরুরি সরঞ্জামের অকার্যকারিতা রোগীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরি করেছে।
২০১০ সালে এই কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও, ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও উপজেলার ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৪৬ জন মানুষ কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। কাগজে-কলমে ৩২টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও, বর্তমানে কার্যত উপস্থিত আছেন মাত্র একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএন্ডএফপিও), একজন আরএমওসহ চারজন মেডিকেল অফিসার। এছাড়া ডা: রিপন কুমার সরকার, ডা: নিরঞ্জন কুমার রায়, ডা: আসমানী সুলতানা, ডা: মো. আশিকুর রহমান ও ডা: মৌসুমী বৈষ্ণবসহ পাঁচজন চিকিৎসক অন্যত্র প্রেষণে থাকলেও বেতন ও নানান সুবিধা এখান থেকেই নিচ্ছেন।সরকারি প্রজ্ঞাপনের পরও হাসপাতালের প্রাঙ্গণে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়, যা আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আউটডোরে ডাক্তার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত থাকার কথা থাকলেও দুপুর ১টার পর ডাক্তার থাকে না। তখন তারা আউটডোরে চিকিৎসা সেবায় ব্যস্ত থাকেন। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের চিকিৎসা সেবায় প্রতিদিন দুই বেলা—অর্থাৎ সকাল-সন্ধ্যা অথবা রাতে—রাউন্ড দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও এখানে সেটা হয় না। বেশিরভাগ ডাক্তার বাইরে সিজারিয়ান রোগী ও ব্যক্তিগত চেম্বার খুলে সেখানে ব্যস্ত থাকেন। অধিকাংশ ডাক্তার আবাসিক কোয়ার্টারে থাকেন না; সেখানে সন্ধ্যার পর উঠতি বয়সী তরুণদের আড্ডা লক্ষ্য করা যায়, যা হাসপাতালের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
জেনারেটর দীর্ঘদিন ধরে অচল। বিদ্যুৎ চলে গেলে জরুরি বিভাগে মোমবাতি ও মোবাইলের আলোতে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হাসপাতালের জুনিয়র মেকানিক ২৪ ঘণ্টা থাকার কথা থাকলেও থাকেন না। অকেজো হয়ে আছে এনালগ এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি সুবিধা। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করাচ্ছেন এবং সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বরাদ্দ থাকলেও বাথরুম থেকে পানি সিঁড়ি দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে। দুর্গন্ধে আশপাশে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নার্সদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে; তারা নাকি হরহামেশা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এছাড়া নার্স ডিউটি রুমের পাশে ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুচ, স্যালাইনের বোতল, গজ ও ওষুধের বাক্স ফেলে রাখা হয়। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অপরিচ্ছন্ন। লাইট ও পাখা মেরামতের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকল হয়ে যায়। রোগীদের খাবারের মানও নিম্নমানের; যা দেওয়া হয় তা খাওয়ার উপযুক্ত নয়। হাসপাতালের প্রবেশদ্বারসহ আশপাশ ময়লা-আবর্জনায় ভরা।
টিকিট ও ভর্তি ফি নিয়েও চলছে নিয়মবিরোধী কার্যক্রম। আউটডোর টিকিটের মূল্য সরকারি নিয়মে ৩ টাকা হলেও বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ৫ টাকা। ভর্তি ফি ৭ টাকা হওয়ার কথা, নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। দুটি অ্যাম্বুলেন্সের একটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল। সরকারি ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা হলেও বাস্তবে ডিমলা থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (৮০ কিমি) পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
নীলফামারীর জেলা সিভিল সার্জন ডা: মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: মোহাম্মদ আলী নোমান বলেন, “ওষুধ, জনবল ও ডাক্তারের সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।''
স্থানীয় রোগীরা বলছেন, “সরকারি হাসপাতালটি যদি ঠিকভাবে পরিচালিত হত, তাহলে আমরা বিদেশি বা বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহন না করেই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা পেতাম।”
সুশীল সমাজের মতে, ডিমলা হাসপাতাল এখন শুধু চিকিৎসা কেন্দ্র নয়, বরং রোগীদের জন্য ভোগান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সহজ হবে না।