কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঐতিহ্যবাহী অষ্টমীর স্নান ও মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রায় ৪০০ বছর ধরে চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ব্রহ্মপুত্র নদে এ পূণ্যস্নান করেন। উপজেলার রমনা নদী বন্দর এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদের তীর থেকে জোড়গাছ বাজার পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় এবারের অষ্টমীর স্নান ও মেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। স্নান উপলক্ষে গতকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র তীরে হাজার হাজার পূণ্যার্থীর ঢল নেমেছিল।
আজ শনিবার(০৫ এপ্রিল) রাত ১টা থেকে স্নান শুরু হলেও শনিবার দুপুর ১২ টা থেকে ১ টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত স্নানের উত্তম লগ্ন ধরা হয়েছে। কিন্তু ভক্তরা শনিবার ভোররাত থেকে স্নান শুরু করে। দিনব্যাপী স্নান ও মেলা চলবে। অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমীর স্নানোৎসব উপলক্ষে হাজারো পূণ্যার্থীর ঢল নেমেছে। পূণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য চিলমারীর রমনা নদী বন্দর থেকে জোড়গাছ বাজার এলাকা পর্যন্ত এবারের স্নানের ঘাট ও মেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। স্নানোৎসব কমিটি ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পূণ্যার্থীদের নিরাপত্তা, স্নান পরবর্তী পোশাক পরিবর্তন এবং পূজা অর্চণার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও কেউ কেউ আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে, কেউ কেউ আবার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় জুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিছানা করে রাত্রী যাপন করেন।
সনাতন ধর্মমতে, চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে পূণ্যতোয়া খ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করলে ভক্তের সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে যায়। পাপমোচনের অভিপ্রায়ে তাই প্রতি বছর জেলা ও জেলার বাইরে থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী পূণ্যার্থী ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করতে আসেন।
দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলা থেকে ষাটোর্ধ বৃদ্ধা মাকে নিয়ে চিলমারী অষ্টমীর স্নানে এসেছেন সুখচরন দাস(৫৫)। তিনি বলেন, শুক্রবার সকাল ১০টায় খানসামা উপজেলা থেকে স্ত্রী সন্তানাদীসহ বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। দিনাজপুর শহর থেকে অষ্টমীর স্নানের জন্য ৬টি বাসে করে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক পূণ্যার্থী চিলমারী অষ্টমীর স্নানে একসাথে এসেছি।
তিনি আরও বলেন, ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করতে আসতাম। বাবা দুই বছর হলো গত হয়েছেন। মায়ের বয়স হয়েছে, এবছর নিজ স্ত্রী সন্তানের সাথে মাকেও নিয়ে এসেছি। ভগবানের কাছে প্রত্যাশা ভগবান অষ্টমীর স্নানের মধ্যদিয়ে মায়ের সকল পাপ মোচন করে দেন।
কুড়িগ্রাম রাজারহাট উপজেলার ফুলখার চাকলা থেকে আসা পিংকি রাণী বলেন, এটি উত্তরাঞ্চলের সবথেকে বড় স্নানোৎসব। ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করলে সকল ধরণের পাপমোচন হয়। পাপমোচনের আশায় এতোদূর থেকে কষ্ট করে এসেছি।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এবারের চিলমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে ১৪০জন পুলিশ সদস্য, ২৫ আনসার সদস্য, ২ ম্যাজিস্ট্রেট, ১টি ডুবুরি দল, একটি মেডিকেল টীম, কাপড় পরিধানের বুথ ৩০টি, অস্থায়ী টিউবওয়েল ১০টি, টয়লেট ২৩টি করা হয়েছে।
স্নানোৎসবে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, স্নানোৎসব কমিটি, হিন্দু মহাজোটের পূণ্যার্থীগণ। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান যুব ঐক্য পরিষদের স্বেচ্চাসেবক কর্ণধর চন্দ্র বর্মণ বলেন, অষ্টমীরস্নান হিন্দুধর্মমতে এটি পূণ্যতম স্নান। এবছর পূণ্যার্থীদের ঢল একটু বেশী। প্রায় দুই লক্ষাধিক পূণ্যার্থী এবারেস্নানে অংশ নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সাথে আমরা স্বেচ্ছাসেবকরা পূণ্যার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য মাঠে কাজ করছি। কোথাও কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা ঘটেনি।
স্নানোৎসব ও পূজা কমিটির সভাপতি সচীন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমীর স্নান প্রায় ৪০০ বছরের পুরাতন ঐতিহ্য। ব্রহ্মপুত্রে স্নান উপলক্ষে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থীর চিলমারীতে এসেছে। দেশের বাইরের পাশ্ববর্তী ভারত থেকেও কোন কোন বাড়িতে অতিথি হয়ে কিছু পূণ্যার্থী এসেছেন। অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে চিলমারী উপজেলার প্রতিটি বাড়িতে উৎসবের আমেজ চলে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ,আনসার বাহিনী ও জনপ্রতিনিধি সহ স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন পূণ্যার্থীদের নানা ভাবে সহযোগিতা করছেন। সব মিলিয়ে ব্রহ্মপুত্র অষ্টমীর স্নানটা সকলের উৎসব হয়ে উঠেছে।