যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ এই দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে যে কয়জন ব্যক্তিত্ব অসাধারণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন একটি উজ্জ্বল নাম। ব্যবসায়ী হিসেবে তার সাফল্য যেমন ঈর্ষণীয়, তেমনি সমাজসেবক ও মানবতাবাদী হিসেবে তার অবদান অনুকরণীয়। স্কটল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশি ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে শুরু করে মাতৃভূমিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ সর্বত্র তার উপস্থিতি মানবকল্যাণের প্রতীক। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি যে অনন্য যাত্রা অতিক্রম করেছেন, তা শুধু একজন ব্যক্তির গল্প নয়, বরং দুটি জাতির মধ্যে ভালোবাসা ও সহযোগিতার এক জীবন্ত ইতিহাস। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হিসেবে তার পুনর্নিয়োগ এই মহান যাত্রার আরেকটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন এমবিই,জেপি-কে “প্রবাসী সম্মাননা- ২০২৫” প্রদান করা হচ্ছে।
আগামী ২৭ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ১১ ঘটিকায় সিলেটের কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে সিলেট জেলা প্রশাসনের আয়োজনে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হবে। এ সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আরো কিছু সংখ্যক প্রবাসীকেও সম্মাননা প্রদান করা হবে। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আইন ও প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। সম্প্রতি সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) মাসুদ রানা ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন এমবিই,জেপি-কে এ সম্মাননার বিষয়টি অবহিত করেন।
সম্প্রতি ড. ওয়ালী তছর উদ্দিনকে দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ২০২৫ সালের ১৬ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট অব ক্রেডেনশিয়াল ড. ওয়ালী তছর উদ্দিনের হাতে তুলে দেন যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটি উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখার জন্য ড. ওয়ালীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশিদের স্বার্থ রক্ষার্থে কিংবা স্কটল্যান্ডে ভ্রমণে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করবেন ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন।
ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন একজন সফল ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও অসাধারণ মানবতাবাদী হিসেবে ব্রিটেন, ইউরোপ ও বাংলাদেশ জুড়ে অধিক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সাফল্যের পালকে যুক্ত হয়েছে এমবিই, ডিবিএ, এফআরএসএ, জেপি। সম্প্রতি তিনি স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।
তার জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। মৌলভীবাজারে শিক্ষালাভের পর ১৯৬৭ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান এবং সেখানে রেস্তোরাঁয় কাজ করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। লন্ডনে শিক্ষা অব্যাহত রেখে রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করার পর লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্যাটারিং শিল্পে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফেডারেশন অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওয়ালী তছর উদ্দিন ক্যাটারিং ব্যবসায় তার দক্ষতার জন্য সুপরিচিত। বিখ্যাত ভেরান্ডা রেস্তোরাঁ, ল্যান্সার্স রেস্তোরাঁ এবং তার সর্বশেষ সফল উদ্যোগ ব্রিটানিয়া স্পাইস রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছেন। সর্বোপরি তার ব্যবসায়িক কর্মপরিধি বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে আছে।
খাবারের ঐতিহ্য ও গুণগত উচ্চমান নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ব্রিটানিয়া স্পাইস অর্জন করেছে অনেকগুলো পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য হলো: Les Routiers Best Newcomer (২০০১); পরপর তিন বছর British Curry Awards-এ Best in Scotland (২০০৫, ২০০৬, ২০০৭); BIBA Award (২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০১৪); Sunday Times Travel Magazine-এর Best Indian Restaurant in Scotland (২০০১); Irn Bru Curry Awards-এ Restaurant of the Year (২০০৮); Bangladesh Caterers Association Restaurant of the Year Award (২০১৪); এবং Good Curry Guide Exceptional Restaurant of the Year Award (২০১৪)। রেস্তোরাঁ খাতে তার অবদান ২০০৬ সালে বিবার ইন্ডাস্ট্রি পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার পুরস্কার এবং এশিয়ান জুয়েল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি পায়।
একজন বিজনেস লিডার হিসেবে তার সাফল্যময় কর্মপরিধি অনুসরণীয়। তিনি এডিনবরা অ্যান্ড লেইথ চেম্বার্স অব কমার্সের ইনস্টিটিউট অব ডিরেক্টরস ও রোটারি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক। তিনি যুক্তরাজ্যে কাউন্সিল অব দ্য ফরেন চেম্বার্স অব কমার্সের পরিচালক, ব্রিটেন ইন ইউরোপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরিচালক এবং ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডন বিজনেস স্কুল অ্যাডভাইজরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। জুনিয়র চেম্বার তাকে ১৯৯২ সালে ইয়াং স্কট অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত করে।
ড. উদ্দিন ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফেডারেশন অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ইবিএফসিআই)-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। মূলধারার ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এই ব্যবসায়ী সংগঠনটি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে বেশ কিছু অগ্রগামী উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ-ব্রিটিশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও মহাপরিচালক হিসেবে ড. উদ্দিন এক্সপো বাংলাদেশ ২০০৫-এ যুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক বাণিজ্য মেলা পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের একশটি কোম্পানি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও অনাবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা এক্সপো বাংলাদেশ ২০০৫-এ অংশ নেয়।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন ২০০০ সালে কুইন মার্গারেট ইউনিভার্সিটি, এডিনবরা থেকে ডক্টরেট ইন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (অনারিস কসা) ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ২০০৭ সালে হেরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স (ডি. লিট.) এবং এডিনবরা ন্যাপিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব দ্য ইউনিভার্সিটি (ডি. ইউনিভার্সিটি) ডিগ্রি লাভ করেন।
ড. ওয়ালী তছর উদ্দিনের মৌলিক চিন্তা ও নতুন উদ্ভাবনী আইডিয়ার সমন্বয় মূলত তাকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার সাফল্যের পালকে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলো স্বীকৃতি। ১৯৮৪ সালে স্কটল্যান্ডের প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জাস্টিস অব দ্য পিস নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম অনারারি কনসাল-জেনারেল নিযুক্ত হন (কিন্তু ২০০৯ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে অনারারি কনসাল স্থগিত হয়ে যায়)। ১৯৯৫ সালে জাতিগত সম্পর্ক উন্নয়নে অবদানের জন্য মেম্বার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই) উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের ফেলো এবং ২০০৩ সালে ডেব্রেটস পিপল অব টুডে-তে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০২৩ সালে কিংস অ্যাওয়ার্ড ফর এন্টারপ্রাইজের বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
একজন মানবিক মানুষ হিসেবে ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন সুপরিচিত। বিশেষ করে মাতৃভূমি বাংলাদেশে মানবিক ও সেবামূলক কাজে অগণিত মানুষের জীবনমান উন্নত করার পাশাপাশি তাদের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। ১৯৯১ সালে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি ১৪০,০০০ পাউন্ডের বেশি অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা দিয়ে একটি টেকসই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি এবং বহরচারা-রত্নপুর উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অন্বেষণের উদ্যোগে তিনি ২২০,০০০ পাউন্ডের বেশি অর্থ সংগ্রহে সম্পৃক্ত ছিলেন, যা দিয়ে অন্বেষণ একটি মডেল গ্রাম ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করে।
ড. ওয়ালী তছর উদ্দিন ব্র্যাক ইউকের সিনিয়র উপদেষ্টা, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রয়্যাল অনার্ড কাউন্সিল (বিবিআরএইচসি)-এর যুগ্ম আহ্বায়ক, সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজের পরিচালক, হার্ট ফাউন্ডেশন এবং স্কটিশ পার্লামেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমিটির উপদেষ্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশে তিনি সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও প্রধান সমন্বয়ক, বাংলাদেশ ফিমেল একাডেমির ট্রাস্টি এবং ঢাকার অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল রোটারি ক্লাব এডিনবরার সদস্য এবং বর্তমানে এনআরবি ওয়ার্ল্ডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
স্কটিশ কমিউনিটিতে তিনি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিটি কর্মী হিসেবে সমাদৃত। তিনি কাউন্সিল ফর বাংলাদেশিজ ইন স্কটল্যান্ডের চেয়ারম্যান, এডিনবরার সেন্ট্রাল মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এবং শাহজালাল মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের ট্রাস্টি। তিনি কমনওয়েলথ সোসাইটি অব এডিনবরা এবং বাংলাস্কট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। বহুজাতিক সমাজে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির মেলবন্ধনে স্কটল্যান্ডে রেখেছেন অনুকরণীয় ভূমিকা। এডিনবরার দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ উৎসব এডিনবরা মেলার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এডিনবরা বাংলাদেশ সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহুমুখী কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। তিনি লিখেছেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘Wali Uddin: Blessed Son of Two Nations’।
মেধা, অধ্যবসায় ও কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানবিক কাজই ড. ওয়ালী তছর উদ্দিনের দেশে-প্রবাসে উজ্জ্বল পরিচয়। তিনি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তিনি বিশ্বব্যাপী সম্মানিত। ব্যবসা ও চ্যারিটি কাজে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব।