দেশেই বাড়ছে কোকেনের চাহিদা, বাড়ছে উদ্বেগ

মোঃ আঃ রহিম জয় চৌধুরী প্রকাশিত: ২১ মার্চ , ২০২৪ ০৭:৫৭ আপডেট: ২১ মার্চ , ২০২৪ ০৭:৫৭ এএম
দেশেই বাড়ছে কোকেনের চাহিদা, বাড়ছে উদ্বেগ
দেশের শীর্ষ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন রোমেল (ছদ্মনাম)। অফিসের এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে কোকেনের সঙ্গে পরিচয় তার। প্রথম দিকে শুধু সপ্তাহান্তে পার্টিতে কোকেন নিতেন।

দেশের শীর্ষ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন রোমেল (ছদ্মনাম)। অফিসের এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে কোকেনের সঙ্গে পরিচয় তার। প্রথম দিকে শুধু সপ্তাহান্তে পার্টিতে কোকেন নিতেন।

একপর্যায়ে নেশাসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। শেষ পর্যন্ত একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে তিন মাস চিকিৎসা নিয়ে মুক্তি পান সেই নেশার কবল থেকে। তবে রোমেল এই অন্ধকার জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও অনেক তরুণ-তরুণী কোকেনের নেশায় নিজেদের নিঃশেষ করে দিচ্ছেন।

একসময়ের অপ্রচলিত মাদক কোকেন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। ফলে এর ব্যবহারও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে কোকেন ধরা পড়েছে প্রায় ৪১ কেজি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, বিভিন্ন দেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশকে কোকেন পরিবহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হলেও দেশে ওই অর্থে কোকেনের বাজার গড়ে ওঠেনি। তবে রোমেলের মতো তরুণরাই জানাচ্ছেন, আরও অনেক মাদকের মতো কোকেনও এখন দেশের প্রচলিত মাদকগুলোর একটি। হরহামেশাই পাওয়া যায় এই মাদক। তবে দাম বেশি হওয়ায় এর পসার কিছুটা সীমাবদ্ধ অভিজাত এলাকাগুলোর মধ্যে।

বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলে পাওয়া গেছে অভিন্ন তথ্য। তারা বলছেন, কোকেনের দাম অনেক বেশি হওয়ায় এর চাহিদা অনেক কম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেশেও বাড়ছে এই ভয়ংকর মাদকের ব্যবহার।

রোমেল জানালেন, প্রতি কোয়ার্টার গ্রাম (এক গ্রামের চার ভাগের এক ভাগ) কোকেন সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে কিনতেন তারা। কখনো গুলশান, কখনো বারিধারা, কখনো নতুন বাজার এলাকা থেকে সংগ্রহ করতেন। স্থান যেটিই হোক, বেচাকেনা চলত অত্যন্ত গোপনে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতেন টেলিগ্রাম বা ডিসকর্ডের মতো অপ্রচলিত মেসেজিং অ্যাপগুলো।

রোমেলরা ৮ থেকে ৯ জনের একটি দল একসঙ্গে কোকেন সেবন করতেন। তাদের সবাই বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর বাসিন্দা। রাজধানীর গুলশানে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে স্যুট ভাড়া করে রাতভর কোকেন সেবন করতেন তারা। আরও দু-একটি কোকেনসেবী দলের সঙ্গেও পরিচয় ছিল রোমেলের। এসব দলের সদস্য প্রায় সব তরুণই এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের সন্তান। কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থী।

একইভাবে কোকেনের সংস্পর্শে চলে আসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী। শুরুতে গাঁজা এবং ইয়াবায় আসক্ত হলেও একসময় জড়িয়ে পড়েন কোকেন-চক্রের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যবসার পাশাপাশি শুরু করেন সেবন। সাভার, আশুলিয়া এলাকা থেকে বিভিন্ন লোক এসে তার কাছে এসব কোকেন দিয়ে যেত। তবে তারা কোথা থেকে এসব কোকেন নিয়ে আসত, সে বিষয়ে জানতেন না । কিছু কোকেন সেবনের জন্য এবং বাকিটা বিক্রির জন্য সংগ্রহ করতেন তিনি। একসময় শারীরিকভাবে চূড়ান্ত খারাপ অবস্থা হয়ে পড়লে রিহ্যাবের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ফিরে দেশের বাইরে চলে যান ওই শিক্ষার্থী।

আরও কয়েকজন মাদকসেবীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যাচ্ছে, গত এক দশকে কোকেন মাদকের বাজারের ‘মূলধারা’য় প্রবেশ করেছে। দাম বেশি বলে এর ক্রেতাগোষ্ঠী কিছুটা সীমিত। তবে তার আকারও দিন দিন বাড়ছে। এ কারণেই এখন কোকেনের ‘ডিলিং পয়েন্ট’ রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে নির্দিষ্টভাবে পরিমাণ জানা না গেলেও কোকেন বেচাকেনার ক্ষেত্রে মাসে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায়ই বিভিন্ন পরিমাণে কোকেন উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বছরের ১৭ জুলাই শ্যামলী এলাকার একটি বাসা থেকে ১০ গ্রাম কোকেন জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এ ঘটনায় সোবহানা রহমান নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ওই নারী জানান, তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে কোকেন নিয়ে আসতেন তিনি। এরপর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এসব কোকেন বিক্রি করতেন। এ ছাড়া ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বনানীর একটি বহুতল ভবন থেকে ৩০ গ্রাম কোকেনসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করে এই বাহিনী। ওই ঘটনায় সেলিম সাত্তার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেলিম সাত্তার সুইজারল্যান্ড এবং বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। তিনি নিজে কোকেন সেবন করেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে কোকেন নিয়ে এসে উচ্চবিত্ত বন্ধু মহলে সরবরাহ করতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, রাজধানী ছাড়াও দেশের ভেতরে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় কোকেনের চালান ধরা পড়েছে। যেগুলো দেশের ভেতরেই বিক্রির জন্য নিয়ে আনা হয়েছিল। ২০২৩ সালে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় ৯২০ গ্রাম কোকেন জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই কোকেন জব্দ করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে এই কোকেন দেশের ভেতরেই বেচাকেনার জন্য সরবরাহ হচ্ছিল বলে ধারণা বিজিবির।

২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৮২০ গ্রাম ওজনের কোকেন জব্দ করে রেপিড  অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এ ঘটনায় বখতেয়ার হোসেন (৩২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।  র‍্যাব জানিয়েছিল, বখতেয়ারের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায়। সে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কোকেন সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে বিক্রি করত। তবে এই কোকেন কার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল সে তথ্য জানা যায়নি।

গত বছর শেষের দিকে ফরিদপুরের ভুলবাড়িয়া গ্রামের আবু বক্কর ওরফে রুবেলের বাড়িতে অভিযান চালায় ডিএনসি। সেখানে ইয়াবার খোঁজে গিয়ে মেলে ব্ল্যাক কোকেন। এটি কোকেনেরই আরেকটি রূপ, যা মেক্সিকো এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যবহৃত হয়। ডিএনসি জানায়, দেশের ভেতর এই মাদকের চাহিদা রয়েছে সেটি আগে জানা ছিল না। কোকেনের এই নতুন রূপ এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, তারা আশা করেননি।

এ বিষয়ে ডিএনসির ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাংলাকে  বলেন
একটি চক্র বাংলাদেশে মরণঘাতী মাদক কোকেনের বাজার তৈরির চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়য় বিভিন্ন অভিযানে কোকেনের ছোট ছোট চালানও ধরা পড়েছে। যেগুলো দেশের ভেতরেই কেনাবেচার প্রক্রিয়া চলছিল। এসব কোকেনের গ্রাহক খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, তারা সবাই অভিজাত পরিবারের সদস্য।

তিনি বলেন, কোকেনের দাম বেশি হওয়ায় এটি এখনো রুট লেভেলে পৌঁছায়নি। বেশিরভাগই বিদেশ থেকে এই মাদক নিয়ে এসে তাদের গ্রাহকদের দেয়। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছি। কোনোভাবেই মরণঘাতী কোকেনকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া হবে না। আমরা এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি অভিযান অব্যাহত রেখেছি।(সূত্র:কালবেলা)

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo