চার লাখ মানুষের জন্য মাত্র চার চিকিৎসক, ৪১টি পদ শূন্য একযুগ ধরে

মোঃ রেজাউল ইসলাম প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল , ২০২৫ ১৩:০৪ আপডেট: ১২ এপ্রিল , ২০২৫ ১৩:০৪ পিএম
চার লাখ মানুষের জন্য মাত্র চার চিকিৎসক, ৪১টি পদ শূন্য একযুগ ধরে
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী সংকটে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী সংকটে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রায় ৪ লাখ মানুষের জন্য নির্ধারিত এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৪ জন। অথচ কাগজে-কলমে চিকিৎসক পদের সংখ্যা ১৮টি, যার মধ্যে ১৪টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৯৯টি জনবল পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৫৮ জন। অর্থাৎ ৪১টি পদ একযুগ ধরে শূন্য। নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, টেকনোলজিস্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও রয়েছে মারাত্মক সংকট।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে চারতলা ভবন নির্মাণের মাধ্যমে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু শয্যা বাড়ানো হলেও জনবল ও অবকাঠামো উন্নয়নের কোনও বাস্তব প্রতিফলন ঘটেনি।

হাসপাতালে চিকিৎসকের গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে রয়েছে আবাসিক মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), কনসালট্যান্ট (গাইনি, অর্থোপেডিক্স, শিশু, ইএনটি, কার্ডিওলজি, চক্ষু, চর্ম ও যৌনরোগ), অ্যানেসথেটিস্ট, ইনডোর ও ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, সহকারী সার্জনসহ প্রায় সব পদই শূন্য।

এছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স, মিডওয়াইফ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারী, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, অফিস সহকারী, স্টোর কিপার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও মালি পদেও লোকবল সংকট রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অল্প কয়েকজন কর্মী দিয়ে হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোর বিভাগে দায়সারা সেবা দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে আংশিকভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

চিকিৎসকের পাশাপাশি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও রেডিওলজিস্টের অভাবে এক্স-রে, আল্ট্রাসোনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেবা অচল হয়ে আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও অপারেটর না থাকায় দিনের পর দিন সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না। রোগীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটছেন। আর দরিদ্ররা চিকিৎসা বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছেন।

এসব বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, 'এটি পুরনো একটি সংকট, সমাধানে সময় লাগবে। জনবল সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের মুয়াজ্জিন বলেন, 'কিছুদিন আগেও প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৪৫০-৫০০ রোগী সেবা নিতে আসতেন। জরুরি বিভাগেও আসতেন শতাধিক রোগী। শয্যার অভাবে অনেক সময় মেঝেতেও রোগী রাখতে হতো। এখন সংকট এতটাই বেড়েছে যে, সেবার মান মারাত্মকভাবে কমে গেছে।

সেবা নিতে আসা ব্যাপারীহাট এলাকার আলামিন হুসাইন বলেন, 'হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো অপরিচ্ছন্ন, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা লেগেই থাকে। টয়লেট দুর্গন্ধে ব্যবহার অযোগ্য। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটরেও তেল না থাকায় সেটি চালু হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগী বলেন, 'সকালবেলা কোমরের ব্যথা নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। এসে শুনলাম, ডাক্তার নেই। ওষুধও নেই, শেষ হয়ে গেছে।

আরেকজন রোগী সফি মিয়া বলেন, 'জরুরি বিভাগ থেকে ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করাতে বলেছেন। এখানে দু’একটা ছাড়া সব টেস্ট বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। আমার তো অত টাকা-পয়সা নেই, কীভাবে করাব?

চিকিৎসক সংকট, অকার্যকর যন্ত্রপাতি, জনবল ও অব্যবস্থাপনার কারণে নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম আজ ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নআয়ের রোগীরা মৌলিক অধিকার—চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo