আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একসময়ের বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রাজশাহীতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনেই একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী মাঠে থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার পাশাপাশি বিভক্তিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রতিটি আসনেই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা তৃণমূল পর্যায়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলের জন্য সঠিক প্রার্থী বাছাই করা এবার একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর): উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও প্রাণহানি
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে। এখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন এবং গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানুল ইসলাম তারেকের মধ্যে। উভয়ের অনুসারীদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গণিউল হক নামে এক বিএনপি কর্মী এবং নেকশার আলী নামে এক কৃষক দল নেতা নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছে। এই আসনে আরও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পপতি সুলতানুল ইসলাম তারেক, ইঞ্জিনিয়ার কেএম জুয়েল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, সাজেদুর রহমান মার্কনি, অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক শাহাদৎ হোসেন শাহীন। তবে, নেতাকর্মীদের মাঝে এমন প্রচারও রয়েছে যে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল থেকে মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী-২ (সদর): পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বনাম সাংগঠনিক তৎপরতা
রাজশাহী সদর আসনে মনোনয়ন নিয়ে মূল আলোচনায় আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এবং মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা। মিনু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ‘ক্লিন ইমেজ’কে পুঁজি করে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকতে চাইছেন। অন্যদিকে, অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা তার সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে তৃণমূলে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। এদের পাশাপাশি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অনুসারীরাও তাকে প্রার্থী করতে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং সাবেক সদস্য সচিব মামুনুর রশিদও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর): সুস্থ প্রতিযোগিতা
জেলার অন্য আসনগুলোর তুলনায় এখানে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহসম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন এবং রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রায়হানুল আলম রায়হান। উভয় নেতাই নিজ নিজ সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। এছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য রায়হানুল হক, মোহনপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুস সামাদ, সাবেক ছাত্রনেতা ইকবাল হোসেন ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত কবীর হোসেনের ছেলে নাসির হোসেন অস্থির।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা): আলোচনা ও পাল্টা আলোচনা
বাগমারা আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান (জিয়া) এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেনের মধ্যে মনোনয়ন প্রতিযোগিতা জমে উঠেছে। তবে ডিএম জিয়ার স্বজনদের বিরুদ্ধে ওঠা কিছু অভিযোগকে তার বিরোধী পক্ষ প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা জটিল। এছাড়াও রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুলও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর): প্রার্থীর ছড়াছড়ি ও উত্তেজনা
এই আসনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র এবং এখানেও দলীয় কোন্দলে হাসিবুল ইসলাম নামে এক বিএনপি কর্মী খুন হয়েছেন। মূল আলোচনায় রয়েছেন পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক এবং কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা। এছাড়াও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডলও জনপ্রিয়তার দৌড়ে এগিয়ে আছেন বলে জানা যায়।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট): অভিজ্ঞতার লড়াই ও জনসম্পৃক্ততা
বাঘা-চারঘাট আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ এবং দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাশীষ রায় মধু। আবু সাঈদ চাঁদ গত নির্বাচনেও দলের প্রার্থী ছিলেন এবং এলাকায় তার শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে, ছাত্রদলের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা দেবাশীষ রায় মধুও নিয়মিত গণসংযোগ, সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছেন। এছাড়াও এই আসনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আরেক সাহসী মুখ হিসেবে পরিচিত সাবেক ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্তকরণ
এদিকে, নির্বাচনী জোট ও যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের জন্য সম্ভাব্য আসন রেখে একক প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে বিএনপি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। যদিও প্রার্থী মনোনয়নের ঘোষণা এখনো দেওয়া হয়নি, তবে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কিছু নেতা মনোনয়নের সবুজ সংকেত পেয়ে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ ও প্রচারের কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ফোনে বেশ কিছু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসংযোগ করতে বলেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মাসেই প্রায় ৭০ ভাগ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
এরই মধ্যে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদকে জরুরি ভিত্তিতে লন্ডনে ডেকে নিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল সকালে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। দলের কেউ কেউ মনে করছেন, জুলাই সনদ এবং নির্বাচনী জোট বিষয়ে সালাহউদ্দিনের সঙ্গে তারেক রহমানের বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।