বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চলমান প্রচেষ্টার মধ্যেই রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত এসআই আব্দুল করিম, যিনি বর্তমানে নগরীর রাজপাড়া থানার লক্ষ্মীপুর পুলিশ বক্সের ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত, তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি এক ব্যক্তিকে আটক করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটলো যখন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে এটিকে ‘জনবিরোধী’ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হচ্ছে।
২০২৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতির (বিআরপিওডব্লিউএ) ৪১তম বার্ষিক সাধারণ সভায় তৎকালীন পুলিশ প্রধান বাহারুল আলম এক অকপট স্বীকারোক্তিতে বলেন, “পুলিশ হয়ে উঠেছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়াল। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে পুলিশকে এমন অবস্থায় আর কখনও পড়তে হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। পুলিশ যাতে আর কখনও জনবিরোধী অবস্থানে ফিরে যেতে না পারে সেই লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান তার যোগদানের পর থেকেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভূমিকা রাখছেন এবং পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। তার বিভিন্ন পদক্ষেপ নগরবাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
কিন্তু বাহিনীর এই ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টার মধ্যেও এসআই করিমের মতো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে রাত আনুমানিক সোয়া বারোটার দিকে তেরোখাদিয়া এলাকার এক গাড়ির ওয়্যারিং মিস্ত্রি, রফিকুল ইসলাম টিটু, গাড়ি পরীক্ষার সময় রোড ডিভাইডারের সাথে দুর্ঘটনায় পড়েন। এসময় লক্ষ্মীপুর পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই করিম ও এএসআই শাহ আলম তাকে বক্সে নিয়ে যান এবং মাদক সেবনের অভিযোগে আটক দেখান। পরবর্তীতে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টিটুর কাছ থেকে এসআই করিম ৪০,০০০ টাকা উৎকোচ নেন বলে অভিযোগ করা হয়। টাকা নেওয়ার পর তাকে আরএমপি ধারায় চালান দেওয়া হয়।
শুধু এই ঘটনাই নয়, এসআই করিমের বিরুদ্ধে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দালাল চক্র, বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ফুটপাত থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে।
এসআই আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। ২০২৪ সালের জুন মাসে স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তাকে রাজশাহী মহানগর ডিবিতে কর্মরত থাকাকালীন ‘গ্রেফতার বাণিজ্যের’ অন্যতম হোতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি এর আগে বোয়ালিয়া মডেল থানার শিরোইল ফাঁড়ির ইনচার্জ থাকাকালীন বিভিন্ন জুয়ার বোর্ড থেকে মাসোহারা তুলতেন এবং ২০২০ সালে চার বন্ধুকে আটক করে টাকা আদায়ের ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। প্রতিবেদনে আরও অভিযোগ করা হয় যে, দামকুড়া থানায় কর্মরত থাকাকালীন তিনি মাদকের গডফাদারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।
এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজপাড়া থানার ওসি হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দুর্ঘটনার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন বলে জানান, তবে টাকা লেনদেনের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেন এবং এসআই করিমকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলেন।
এদিকে, রাজশাহী শহর রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ এবং সচেতন নাগরিক সমাজ (সনাক)-এর মতো বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংস্থার সদস্যরা এসআই করিমের কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, আরএমপি কমিশনারের ইতিবাচক উদ্যোগ সত্ত্বেও কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।