বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের প্রাণ বলে খ্যাত বাঁকখালী নদী, আজ মৃত্যুপথযাত্রী। একসময় এটি ছিল স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, নৌপরিবহন ও বাণিজ্যের অন্যতম উৎস। জেলার ভূতাত্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এই নদী বহন করে কক্সবাজারের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবিকার প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দখল, দূষণ ও ভাঙনের কবলে পড়ে নদীটি হারাতে বসেছে তার অস্তিত্ব। এখন নদী টিকিয়ে রাখাই পরিবেশবিদদের প্রধান উদ্বেগ।
শহরের অভ্যন্তর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। ময়লা-আবর্জনা ফেলা, প্যারাবন ধ্বংস ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাঁকখালীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর বুক জুড়ে জেগে উঠছে চরের পর চর, ফলে নৌচলাচল প্রায় বন্ধ। আশির দশকে বিআইডব্লিউটিএ অফিসসংলগ্ন জেটি ঘাট এখন সরতে সরতে নুনিয়ারছড়ায় গিয়ে ঠেকেছে।
স্থানীয় জেলেরা জানায়, দশ বছর আগেও নদীতে নিয়মিত নৌকা চলাচল ছিল। এখন বর্ষা ছাড়া নৌকা চালানো প্রায় অসম্ভব। বর্ষায়ও নদীর পানি কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, মাছ মরে ভেসে ওঠে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শহরাংশে নদীর প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা দখল হয়ে গেছে। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে দ্রুতগতিতে।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি তৌহিদ বেলাল বলেন, বাঁকখালী নদী হচ্ছে কক্সবাজার শহরের ফুসফুস। দখল-দূষণে নদীর প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চিহ্নিত দখলদাররা নদীর পাড় ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে। প্রশাসনের উচিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দখলদারদের উচ্ছেদ করা।
কক্সবাজার সোসাইটির সভাপতি কমরেড গিয়াস উদ্দিন বলেন, বাঁকখালী নদী আজ ভুমিগ্রাসীদের রোষানলে পড়ে ঐতিহ্য হারাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে নদীর জমি খতিয়ানভুক্ত ও রেজিস্ট্রি করা হয়েছে-যা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এদের আইনের আওতায় এনে নদীটিকে পুনরায় প্রবাহমান করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, বাঁকখালী নদী কক্সবাজারের আধার। কয়েকজন দখলদারের কারণে ২৮ লাখ মানুষ কষ্ট পেতে পারে না। সরকারকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্থানীয় নাগরিক আন্দোলন কর্মী নুরুন নাহার বেগম জানান, প্রশাসনের মাঝে মাঝে অভিযান দেখা গেলেও তা অস্থায়ী। স্থায়ীভাবে দখল উচ্ছেদ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা না নিলে কিছুদিনের মধ্যেই নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঁকখালী নদী বাঁচাতে জরুরি তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে-১️. নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলদার উচ্ছেদ ২️. বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন ৩️. নদী পুনঃখনন ।
নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, পরিবেশকর্মী ও সাধারণ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই পারে প্রকৃতির এই শিরাকে আবারও জীবিত করতে।